সাদামাটা জাতীয় সম্মেলনেও থাকতে পারে ‘চমক’
৩০ অক্টোবর ২০২২ ২১:৪৪
ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন ২৪ ডিসেম্বর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বিবেচনায় এবার জাঁকজমক আয়োজনের পরিবর্তে সাদামাটা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাদামাটা সম্মেলনের মাধ্যমে বিশেষ কী বার্তা বা চমক থাকছে, তা নিয়ে দলীয় ঘরানায় চলছে জল্পনা-কল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, সম্মেলন সাদামাটা হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা চমক দিতে পারেন। চমক আসাটাই স্বাভাবিক বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা।
২৮ অক্টোবর গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করে দলটি। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলন সাদাসিদেভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি বৈঠকের শুরুতেই বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘এবারের সম্মেলনে শান-শৌকত থাকবে না। খুব সীমিত আকারে, অল্প খরচে সাদাসিধাভাবে করতে হবে।’
পরে বৈঠকের বিরতিতে সন্ধ্যায় গণভবনের গেটে সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘২৪ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এবার সম্মেলন হবে একদিন, থাকছে না জাকজমকপূর্ণ কিছু। বৈশ্বিক সংকটের কারণে কৃচ্ছ্রতা সাধন করা হবে। সম্মেলনের প্রথমদিকে উদ্বোধনী অধিবেশন, এরপর কাউন্সিল অধিবেশন, আর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।’
সেদিনের বৈঠক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এদিকে, সম্মেলনকে সফল করার লক্ষ্যে রোববার (৩০ অক্টোবর) সকালে ১১টি সম্মেলন প্রস্তুতি উপকমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের জাতীয় সম্মেলন পূর্ব প্রস্তুতি সভা শেষে দফতর সেল থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
সভা শুরুর আগে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সভাপতি। এ ব্যাপারে আমরা কো-অর্ডিনেট করছি। সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনে নেত্রীকে তারা চান। তাই নেত্রীর সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে তারিখগুলো আমরা দিয়ে দেব। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। জাতীয় সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ অনেকগুলো সম্মেলন হবে। এগুলো আমরা করে ফেলব। ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোগী সব সাংগঠনিক সম্মেলন হবে জাতীয় সম্মেলনের আগে। এছাড়া গণভবনে প্রতি সপ্তাহে জেলা আওয়ামী লীগের দুটি করে ইউনিটের সঙ্গে বসে বর্ধিত সভা করবেন আওয়ামী লীগ প্রধান।’
এদিকে, সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণের পর দলীয় ঘরানায় জল্পনা-কল্পনার পাল্লা ভারি হয়ে উঠছে। নেতাকর্মী জানতে চান, কী চমক থাকছে আওয়ামী লীগের সাদামাটা সম্মেলনে? বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের কি তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকছেন, নাকি নতুন কেউ আসছেন? তা নিয়ে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। যদিও বিষয়টি কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্ধারণ করবেন। সেইসঙ্গে আগামী সম্মেলনে নতুন মুখ কারা আসছে, কারা বাদ পড়ছে- তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘সম্মেলন সাদামাটা হলেও বিশেষ কোনো চমক তো অবশ্যই থাকবে। কারণ, আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা সবকিছু মাথায় ঠিক করে নিয়েই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছেন।’
ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২১টি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করেছে। ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত ২১টি সম্মেলনের মধ্যে পাকিস্তান আমলে আটটি আর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৩টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় প্রয়োজনে দলটি বিভিন্ন সময়ে সাতটি বিশেষ সম্মেলন করেছে। সম্মেলনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বাধিক দশম বারের মতো দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু টানা চার বার দলটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে, তিনি চার বার সাধারণ সম্পাদক এবং প্রতিষ্ঠার সময়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
অন্যান্য সভাপতির মধ্যে আবদুল হামিদ খান ভাসানী চার বার, আব্দুর রশীদ তকর্বাগীশ, এইএইচএম কামারুজ্জামান ও আব্দুল মালেক উকিল এক বার করে সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে জিল্লুর রহমান দায়িত্বে ছিলেন চার বার; তাজউদ্দিন আহমেদ তিন বার, আবদুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দু’বার করে এবং শামসুল হক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও আবদুল জলিল এক মেয়াদের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চলতি মেয়াদসহ দু’বার দায়িত্ব পালন করছেন।
২২তম জাতীয় সম্মেলন ঘিরে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে। সম্মেলন ঘিরে তার প্রত্যাশা ও চমকের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সম্মেলনই হলো একটি চমক। স্বাভাবিকভাবেই এই সম্মেলনে আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু নেতা নির্বাচনই তো আওয়ামী লীগের মতো একটা পার্টির মূল উদ্দেশ্য নয়। সম্মেলেন আমাদের নেত্রী নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী করণীয় নিয়ে পার্টিকে একটি গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। এই কাউন্সিলেও পার্টিকে তিনি একটি গাইডলাইন দেবেন। সেই গাইডলাইন অনুসারে পার্টি আগামী তিন বছর চলবে। কাজেই এটাই একটি চমক। সেখানে তিনি আগামী নির্বাচনি ইশতেহার নিয়ে কথা বলবেন।’
সাবেক প্রতিমন্ত্রী নানক আরও বলেন, ‘সামনে বিএনপি দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে। যারা বাস পুড়িয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে- বিএনপির সেই ক্যাডারদের জনসভায় ফের দেখা যাচ্ছে। আত্মগোপন থেকে তারা রাস্তায় বেরিয়ে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘কাউন্সিল মহাযজ্ঞের পরে নির্বাচন। আমার মনে হয়, এই নির্বাচন হবে সত্তরের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন। সত্তরের নির্বাচনটি যেমন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে মানুষ কি না? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সত্তরের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল। সেই উন্মেষ নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামনের নির্বাচনটি হবে। কারণ, এবার আওয়ামী লীগের জয়ের সঙ্গে নির্ভর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে রক্ষার করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আপ্রাণ চেষ্টা করবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির জন্য। সেই চেষ্টা তারা করবেই। সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তো অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সম্মেলন আয়োজন সাদামাটা হলেও বিশেষ কোনো বার্তা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন নেত্রী।’
সম্মেলন নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্মেলনে চমক থাকবে। আয়োজন খুবই সাদামাটা, কিন্তু উপস্থিতি হবে ব্যাপক। বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও সংকট মোকাবিলা করছে। সেই সংকট মোকাবিলার অংশ হিসেবেই আমাদের সম্মেলনের ব্যয়ভার কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে সম্মেলনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কারণ, এই সম্মেলনকে ঘিরেই আগামী নির্বাচনের জন্য কাজ করতে হবে।’
প্রত্যেক সম্মেলনে তো সংযোজন-বিয়োজন বা পদোন্নতির প্রসঙ্গ থাকে। এবারও কি সেরকম কিছু থাকছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। প্রত্যেক সদস্যের কর্মকাণ্ড নেত্রীর নখদর্পণে রয়েছে। সুতরাং উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কাকে, কোন জায়গায় কাজে লাগাবেন; কে কোন জায়গার জন্য বেশি যোগ্য বিবেচিত হবেন। সেই ব্যাপারগুলো নেত্রীই ঠিক করে থাকেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে হ্যাঁ সংগঠনের কিছু লোক হয়তো বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। অসুস্থতার কারণে কাজকর্ম করতে পারছেন না? এমন যদি কেউ থেকে থাকেন অথবা কাউকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি আশানুরূপ ফল দিতে পারেননি, সেক্ষেত্রে পরিবর্তন হতেই পারে। সেই পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়া নতুনদেরও জায়গা করে দেওয়ার প্রশ্ন রয়েছে। সবকিছু মিলে কিছু জায়গায় পরিবর্তন আসতেই পারে।’ এবং সেটি আনতে হলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান আব্দুর রহমান।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম