শর্মী রায়: শত মানুষের মাঝে ‘আলো’ হাতে
৩১ অক্টোবর ২০২২ ০০:০৯
ঢাকা: শর্মী রায়। বয়স তার ৩৪ কিংবা ৩৫ ছুঁইছুঁই। শারীরিক গঠনে অন্য দশজন মানুষের মতো নন তিনি। জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পলসিতে ধুঁকতে হচ্ছে তাকে। বয়স বাড়লেও বাড়ছে না চলাফেরার স্বাভাবিক শক্তি। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ তার। ফলে চলাফেরা করতে হয় ক্র্যাচের সাহায্যে।
শারীরিক প্রতিবন্ধতার মধ্যেও শর্মী রায়ের মানসশক্তি প্রেরণা জোগানোর মতো। আর দশজন থেকে আলাদা এই তরুণী কষ্ট করে শিখে নিয়েছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ। তার মতোই ধুঁকতে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গড়ে তুলেছেন কল্যাণ সংগঠন পারসন উইথ সেরিব্রাল পলসি ফাউন্ডেশন (পিসিপিএফ)। এই পিসিপিএফ’ই আলোর পথ দেখাচ্ছে শত মানুষের।
শরীর যখন ‘শত্রু’: জন্মসুত্রে শরীয়তপুরে শর্মীর বাড়ি হলেও ঢাকাতেই বেড়ে উঠেছেন। বাবা সুশীল কুমার রায় মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তিন বোনের দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন মাকে নিয়েই রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন শর্মী।
তিনি জানান, জন্মগর্ভে থাকতেই তিনি সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত হয়েছিলেন।
চলাফেরা তো দূরের কথা, কোনো কিছুর সহযোগিতা ছাড়া এখন দাঁড়ানোই প্রায় অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতেও কাজ করছেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য।
শর্মী বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। কোমর থেকে পা পর্যন্ত আমার শক্তি কম। চলাফেরা করতে অসুবিধা হলেও আমি কাজ করতে পারি।’
বলে রাখা ভালো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সেরিব্রাল পলসি একটি শারিরীক গঠনগত সমস্যা। মূলত জন্মের আগে মস্তিস্কে আঘাতজনিত কারণে রক্ত চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাকেই সেরিব্রাল পলসি বলা হয়ে থাকে।
সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুরা জন্মের পর ঠিকমত বেড়ে উঠতে পারে না। বিশেষ করে এ সমস্যায় আক্রান্তরা ঠিকমত বসতে, হাঁটতে বা চলাচল করতে পারেন না। আবার কারও কারও অটিজম সমস্যাও হয়ে থাকে। শিশুর জন্মের পর পরই এই সমস্যা বোঝার উপায় থাকেনা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা প্রকাশ পেতে থাকে।
ইশ! লেখাপড়াটি যদি হতো: শর্মীর ইচ্ছা ছিল পড়ালেখাটি ঠিকঠাক মতো করার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার শরীর। এ কারণে অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরোনো হয়নি তার। পরে অবশ্য স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে আর ভর্তি করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও থেমে থাকেনি স্বপ্নের পথে হাঁটার কাজটি। নিজের চেষ্টায় প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন। ঘরে বসেই টিউটরিয়াল দেখে আয়ত্ত করেন গ্রাফিক্স ডিজাইন।
প্রাতষ্ঠানিক লেখাপড়া করতে না পারায় কিছুটা আক্ষেপও রয়েছে তার। শর্মী বলেন, ‘আমার বাবা-মা আর এগোননি। অনেক বাবা-মা আছেন সন্তানের এ সব বিষয়ে লড়াই করে থাকেন। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন নয় বলে বাবা-মা তা করতে পারেননি।’
বাধা পেরিয়ে আলো হাতে: সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শর্মী রায় গড়ে তোলেন পারসন উইথ সেরিব্রাল পলসি ফাউন্ডেশন (পিসিপিএফ) নামে একটি সংগঠন। আর এই পিসিপিএফ’ই আলোর পথ দেখাচ্ছে তার মতো শত মানুষের।
২০১৬ সালে শুরু করা পিসিপিএফ’র সদস্য সংখ্যা এখন ৪০। নিজে পালন করছেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বেতনভুক্ত হয়ে কাজ করছেন ওই সংগঠনে।
শর্মী জানান, গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে জয়েন্ট স্টকের নিবন্ধন পায় পিসিপিএফ। এখন চেষ্টা চলছে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধন পাওয়ার।
সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখ করতে গিয়ে শর্মী বলেন, ‘যে সব শিশু আমার মতো অবস্থা নিয়ে জন্মায় তাদের জন্য কাজ করতে চাই। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা আমাদের অভিপ্রায়। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানও করতে চাই। তারা যেন আত্মনির্ভশীল হয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারেন।’
তিনি জানান, তার সংগঠনের লক্ষ্য হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে স্বনির্ভর করে তোলা। সে জন্য সমাজের সব শ্রেণির মানুষের উদ্যোগ চান তিনি।
তবে করুণা নয়, কাজের সুযোগ তার আরাধ্য। শর্মীর দৃপ্ত উচ্চারণ— করুণা করে কেউ অর্থ সহায়তা করুক চাই না। আমরা কাজের সুযোগ চাই। কাজের মাধ্যমেই নিজেরা দাঁড়াতে চাই।
রসুই ঘরে ব্যস্ততা: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইনারের চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিলেন শর্মী রায়। শর্মী জানান, করোনার সময় চাকরিটি চলে যায় তার। তখন মাথায় আইডিয়া আসে অনলাইনে খাবার বিক্রির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চালু করেন ‘অহনা রন্ধনশালা’ নামের একটি রান্নার পেইজ। শুরুতে কিছুটা সমস্যা হলেও পরিচিতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। তার ক্যাটারিং সার্ভিস অল্প সময়েই হয়ে ওঠে জনপ্রিয় । অনলাইনে খাবার বিক্রির পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠানের খাবার বিক্রি হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ব্যাংকের ক্যান্টিনে।
শর্মীর সঙ্গে কথা হয় মহাখালী লিংক রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ক্যান্টিনে। শুক্র ও শনিবার বাদে সপ্তাহের পাঁচদিন ‘অহনা রন্ধনশালা’র খাবার নিয়ে আসেন এই ক্যান্টিনে। আর এ কাজের জন্য রয়েছে বেতনভুক্ত চারজন নারী বাবুর্চি। যারা কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করেন রান্না। সকাল এগারোটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ওই খাবার বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, ‘মূলত দুপুরের খাবারটা আমরা এখানে দিয়ে থাকি। এখানে ভাত, মাছ , মাংস, ভর্তা, পোলাও, খিচুরি টাইপের খাবারের আইটেম থাকে। তিন মাস ধরে এই ক্যান্টিনে খাবারের ব্যবস্থা করছি। বেশ সাড়া পাচ্ছি। যে খাবার নিয়ে আসি তা আর ফিরিয়ে নিতে হয় না। সব বিক্রি হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে কেবল আমাদের অফিসের খরচটুকু উঠে আসে। তবে বাকি কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
আকাশটাকে ছোঁব বলে: প্রতিবন্ধী হিসেবে কোনো সুবিধা পান না শর্মী রায়। আবেদনও করেননি কখনো। এমনকি তার সঙ্গে যারা কাজ করেন তারাও সরকারি সুবিধা নেন না।
শর্মী বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও ধরন রয়েছে। সবাই অনুদানে চলবে সেটি ঠিক নয়। আমি তো কাজ করতে পারি আমি কেন ভাতা নেব। আমি কোনো ভাতার জন্য আবেদন করিনি। কারণ আমরা যারা কাজ করে খেতে পারি, তাদের উচিত ভাতার চিন্তা না করা।’
নিজের স্বপ্নের সংগঠন সম্পর্কে শর্মী বলেন, ‘এই সংগঠনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা নেই। সমাজের বিত্তবান মানুষের সহযোগিতা আর প্রেরণায় সংগঠনকে এতদূর এগিয়ে নিতে পেরেছি।’
শর্মী জানান, তার সংগঠন থেকে বছরে একটি দাবা টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো। একটি স্কুলপ্রতিষ্ঠা করারও পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু গত দুইবছর করোনার কারণে ফান্ড কমে যাওয়ায় একরকম বিপদে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার এই সংগঠনকে এগিয়ে নিতে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে দরকার প্রেরণাও।’
শর্মী বলেন, ‘আমাদের এই সংগঠনের জন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে আসে তাহলে উপকার হয়। আমরা মিলেমিশেই কাজগুলো এগিয়ে নিতে চাই। আমরা কাজ করতে চাই, কাজের সুযোগ চাই। এভাবেই হয়ত একদিন অনেক দূর এগিয়ে যাব। আজ অথবা কাল— আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবই।’
সারাবাংলা/জেআর/একে