Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কমছে পাহাড়ি বাঁশের চাহিদা, বাড়ছে পথে পথে ‘চাঁদাবাজি’

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩১ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৫৩

রাঙ্গামাটি: একসময় প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেডে (কেপিএম) পাহাড়ের উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে কাগজ তৈরি হতো। পাহাড়ি বাঁশ দিয়ে রূপান্তরিত সেই কাগজ ছড়িয়ে যেত দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে এখন আর বাঁশ দিয়ে কাগজ তৈরি হয় না কেপিএমে। মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এই প্রতিষ্ঠানে বাঁশ দিয়ে কাগজ উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধের পরপরই পাহাড়ের বাঁশের চাহিদা কমে যায়।

বিজ্ঞাপন

এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড়ের বাঁশ বাজারজাতকরণ হলেও দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহনে বাড়তি ভাড়া ও পথে-পথে চাঁদাবাজির কারণে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, অন্যান্য বছরে গড়ে ৫ হাজার ট্রাক বাঁশ পরিবহন হলেও এবার ৩ হাজার ট্রাক হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ব্যবসায় লোকসান দেখা দেওয়ায় বিকল্প পথ খুঁজছেন তারাও।

পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটির কাউখালী, কাপ্তাই, নানিয়ারচর উপজেলা ও জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ বাজারজাত করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি জেলা সদরের কুতুকছড়ি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, তিন মাস বাঁশ বাজারজাত থাকার পর এক সেপ্টেম্বর থেকে আবারও কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিক-ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি ট্রাকে করে বাঁশবোঝাই করা হচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলার পরিবহনের উদ্দেশে।

স্থানীয় পাইকারি বাঁশ ব্যবসায়ী আব্দুল হক জানান, ১ জুন থেকে তিন মাস বাঁশ পরিবহন বন্ধের পর আবারও বাঁশ বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। এতে শ্রমিকরা কাজে ফিরলেও পাইকার ব্যবসায়ী যারা আছেন, তারা এবার বিপাকে পড়েছেন। গত বছরের চেয়ে এবছর পরিবহন খরচ ব্যয় অনেক বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম লিটারে প্রায় অর্ধেক বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন ভাড়াও অর্ধেক বেড়েছে। কিন্তু বাঁশের দাম ও বিক্রয়মূল্য আগের মতো থাকায় ব্যবসা এখন ভালো নেই। জ্বা

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া পাহাড়ের বিবাদমান আঞ্চলিক দল ছাড়াও রাঙ্গামাটি এরিয়া থেকে বের হওয়ার পর কক্সবাজারের টেকনাফ যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন এলালায় হাইওয়ে পুলিশ ও ফরেস্ট চেকপোস্টে নানা অজুহাতে চাঁদাবাজির কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

বিজ্ঞাপন

আব্দুল হক জানান, কুতুকছড়ি বাজারে ২০ জন পাইকার বাঁশ ব্যবসায়ী রয়েছেন। যারা খুচরা ব্যবসায়ী ও চাষীদের কাছ থেকে বাঁশ কিনে বাজারজাত করে থাকেন। এছাড়া খুচরা ব্যবসায়ী আছেন আরও ৫০ জনের মতো।

স্থানীয় বাঁশ ব্যবসায়ী মঙ্গল বিন্দু চাকমা জানান, নানিয়ারচর উপজেলায় হাতিমারা, নানাকুড়ম, নানিয়ারচর, বুড়িঘাট, তৈ চাকমা, বেতছড়ি, কেঙ্গালছড়ি, পুটিখালীসহ অন্যান্য এলাকায় পাহাড়ি বাঁশ উৎপাদন ও আহরণ করা হয়। তবে দিন দিন বাঁশের উৎপাদন ও ব্যবহার কমে আসছে।

লক্ষ্মীপুর থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান জানান, জ্বালানি তেলের কারণে পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে। পুলিশের চাঁদাবাজি আর ফরেস্টের বিভিন্ন চেকপোস্টে টাকা দিতে হয়। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা আগের মতো ভালো ব্যবসা করতে পারছেন না। লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়দের ঘরের বেড়া, টেংরা বেড়াসহ আসবাবপত্র তৈরিতে এসব বাঁশ ব্যবহার করা হয়। তবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ায় পরিবেশবান্ধব বাঁশের ব্যবহার কমে আসছে।

নানিয়ারচর উপজেলা বাঁশ ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাঁশ পরিবহনকারি প্রতিটি গাড়িতে (ট্রাকে) ২৮০০ থেকে ৩০০০টি বাঁশ পরিবহন করা যায়। প্রতিটি বাঁশের উপর প্রায় ১ টাকা ৮০ পয়সা হারে শুল্ক দিতে হয় বন বিভাগকে। এছাড়া ট্রাক প্রতি পাহাড়ে বিবাদমান আঞ্চলিক দলকে চাঁদাবাবদ সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়াও গাড়ি পরিবহনে লাইন খরচ হিসাবে হাইওয়ে পুলিশ ও বিভিন্ন পয়েন্টে ফরেস্টের চেকিং পোস্টসহ মোট ২৬ হাজার টাকা লাইন খরচ হিসাবে ব্যয় হয়ে থাকে। এর বাইরে রয়েছে গাড়ি ভাড়া, শ্রমিকের খরচ। প্রতিটি গাড়িতে করে গড়ে দেড় লাখ টাকার বাঁশ পরিবহন করা হয়। সে হিসাবে বাৎসরিক নানিয়ারচর উপজেলার অধীনে কুতুকছড়ি থেকে কেংগালছড়ি গড়ে ৫০০০ ট্রাকে বছরে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে। বাঁশ পরিবহনকারি প্রতিটি গাড়ি লম্বায় ১৮ ফুট হয়ে থাকে কিন্তু বাঁশের আয়তন ২৪ ফুট হওয়ায় বাড়তি ভার হিসাবে লাইনখরচ বেড়ে যায় পাইকার ব্যবসায়ীদের।

বন বিভাগ রাঙ্গামাটি অঞ্চলের বাঁশ বাজারজাতকরণ ও শুল্কহার আদায়ের বার্ষিক হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, পাহাড়ে বাঁশ উৎপাদন ও সরকারের রাজস্ব আয় দুটোই কমেছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি অঞ্চলের অধীন রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮০টি বাঁশ বাজারজাতকরণ করা হয়; এর বিপরীতে বন বিভাগ শুল্ক আদায় করেছিল ২ কোটি ৯৪ লাখ ৬১ হাজার ৯৮৭ টাকা। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১৮ লাখ ৬১ হাজার ২৪৯টি বাঁশের বিপরীতে ২ কোটি ২০ লাখ ৯২ হাজার ৬২০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সরকারি হিসাবেই বিগত ৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশের উৎপাদন ও বাজারে চাহিদা কমার কারণে প্রক্রিয়াজাত কমেছে।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রাঙ্গামাটি সদর, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল, নাড়াইছড়ি, মাচালং, পশ্চিম লক্ষীছড়ি, পূর্ব লক্ষীছড়ি, বাঘাইহাট, শিজক পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি, রেংকার্য্য, ছোট মেরুং, বড় মেরুং, কবাখালী, তারাবুনিয়া, ঘাগড়া, কচুখালী, ঘিলাছড়ি, মুবাছড়ি, কলমপতি, না ভাঙা, খাসখালী, উল্টাছড়ি, লংগদু, ইয়ারিংছড়ি, মাইনিমুখ, সাপছড়ি, মানিকছড়ি, হেমন্ত মোন, বসন্ত মোন, কাইন্দ্যা, ফুলগাজী, বাপেরছড়া, কুতুবদিয়া, ভার্য্যতলী, বারদপোলা, সাক্রাছড়ি, বহালতলী, ঘিলাছড়ি, ছোট মহাপুরম পুর, হাজাছড়ি, বুড়িঘাট, তৈ চাকমা, ক্যাঙ্গালছড়ি, লেমুছড়ি, চৌংড়াছড়ি, থলিপাড়া, নুনছড়ি, লক্ষীছড়ি, বানরকাটা, ছোট ধ্ৰুং, জারুলছড়ি, দুল্যাতলী, ময়ূরখীল, দেবালছড়ি, গোইনছড়ি, রাঙাপানি, রাজভিলা, রাইখালী, রাজস্থলী, ধনুছড়ি, খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, রামগড়, মানিকছড়ি এলাকায় বাঁশ উৎপাদন, আহরণ ও বাজারজাতকরণ করা হয়।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বাজালী, ছোটিয়া, মুলি, টেংরা মুলি, ওরাহ, মিতিঙ্গা, ডলু, নলি, বাড়িওয়ালা, ছাতারবাটা ও কালিছড়ি জাতের বাঁশ উৎপাদন হয়ে থাকে।

পাহাড়ের বাঁশ উৎপাদন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষে প্রতি বছরের ১ জুন থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাঁশ কর্তন, আহরণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বাঁশের বংশবিস্তারের সময় জনসমাগম এলাকায় প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বাঁশ কর্তন ও পরিবহণে জনগনকে নিরুৎসাহিত করা হয়। পার্বত্য এলাকায় জনসাধারণকে বাঁশ কোড়ল (কচি বাঁশ) সবজি হিসেবে বাজারজাত না করার জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়। এছাড়া জুম চাষের সময় যাতে বাঁশের ঝাড়ে আগুন দেয়া এবং বাঁশ পোড়ানো না হয়, সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তারা স্থানীয় প্রশাসন, হেডম্যান, কার্বারির সঙ্গে যোগাযোগ করে সময়ে সময়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

জেলার নানিয়ারচর উপজেলা বাঁশ ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি সেকান্দার শরিফ বলেন, ‘অন্য বছরে গড়ে ৪-৫ হাজার ট্রাক বাঁশ পরিবহন হয়ে থাকে কুতুকছড়ি থেকে কেংগালছড়ি পর্যন্ত শুধুমাত্র এই এরিয়াতেই। কিন্তু চলতি বছর ব্যবসায়ের যে হাল ৩০০০ ট্রাক বাঁশ পরিবহন হবে বলে মনে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের কারণে ভাড়া বাড়া, হাইওয়ে পুলিশ ও জায়গায় জায়গায় ফরেস্টের চেকপোস্টে টাকা দিতে দিতে ব্যবসায়ে আর লাভ থাকে না। এবছর প্রায় গাড়িতেই গড়ে ৪-৫ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও উপবন সংরক্ষক অজিত কুমার রুদ্র জানান, পাহাড়ে প্রাকৃতিক বাঁশ বাগান কমছে ও উৎপাদন কমে যাচ্ছে এটা সত্য। এর প্রধানত কারণ হলো বাঁশ বাগানগুলো কিংবা জুমে আগুন দেওয়ার কারণে বাঁশের মুড়া ধংস হচ্ছে আবার আগুনের কারণে বাঁশের রাইজোম ভেতরেই নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয় যে কারণ সেটি হলো অধিকহারে বাঁশ কোড়ল খাদ্য হিসাবে গ্রহণের প্রবণতা আরও বেড়েছে। আগে সাধারণ পাহাড়িরা বাঁশ কোড়ল খেলেও এখন স্থানীয় বাঙালি অধিবাসীদের পাশাপাশি এটার বাণিজ্যিক চাহিদা বেড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঁশ বাণিজ্যিকভাবে পাঠানো হচ্ছে। এগুলোই পাহাড়ে বাঁশের উৎপাদন কমার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে বিগত সময়ে পাহাড়ের বনায়ন হচ্ছে না; যে কারণে বাঁশসহ অন্যান্য বনজ বৃক্ষের পরিমাণও কমছে।

পাহাড়ে বনায়নের বাধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সহজ কথায় যদি বলি, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে এখানে বনায়ন করা সহজ হয়ে উঠছে না। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ফলদ বাগান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়ায় স্থানীয়রাও বনজ ছেড়ে ফলদ বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু এটি পরিবেশ ও বনের জন্য সুখবর বয়ে আনবে না।’

সারাবাংলা/এমও

চাঁদাবাজি পাহাড়ি বাঁশ বাঁশ রাঙ্গামাটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর