Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পরিস্থিতি ও সুযোগ’ বুঝে মাঠে নামছে হেফাজতে ইসলাম

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩১ অক্টোবর ২০২২ ২২:৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মুরুব্বি নেতাদের মৃত্যু এবং অধিকাংশ শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর চুপসে যাওয়া কওমিপন্থিদের সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ফের ‘গা ঝাড়া’ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকটি কমিটি পুনর্গঠনও করা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে ফের মাঠে নামার ঘোষণা এসেছে।

আগামী ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় উলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একযুগ বয়সী হেফাজতে ইসলাম। এতদিন সংগঠনটির নেতারা এই দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেন-দরবার করে আসছিলেন।

বিজ্ঞাপন

২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবরোধ কর্মসূচিতে তাণ্ডব চালিয়ে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। এর পর ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে সহিংস আন্দোলনে নেমেও আলোচনায় আসে সংগঠনটি। যদিও ওই সময় তারা সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড়ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এরপর মামলা-গ্রেফতারে দেড় বছর ধরে কার্যত ‘নিষ্প্রাণ’ থাকা নেতাকর্মীদের ফের সরব হওয়া নিয়ে হেফাজত নেতারা বলেছেন, ‘পরিস্থিতি এবং সুযোগ তৈরি হওয়ায় তারা আবার মাঠে নামছেন।’

এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের বিদ্যমান নেতাদের সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনের ‘গোপন সমঝোতার’ আভাস মিলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার।

২০১০ সালে দেশের কওমি অঙ্গনের প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়। আহমদ শফী আমির এবং জুনায়েদ বাবুনগরী প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৩ সালে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির নামে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছিল সংগঠনটি। পরবর্তী সময়ে নানা পটপরিক্রমায় শফী ও বাবুনগরীর অনুসারীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তবে শফী জীবিত থাকা অবস্থায় সংগঠন বিভক্ত হয়নি।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসায় তিনদিন শফীকে অবরুদ্ধ করে রাখে ছাত্ররা। ওই সময় বিক্ষোভের মধ্যে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা শফী মারা যান। মৃত্যুর পর থেকে তারা অনুসারীরা তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে আসছিলেন।

মূলত এর মধ্য দিয়ে দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলাম। একভাগে শফীপন্থিরা, আরেকভাগে বাবুনগরীর অনুসারীরা। শফীর মৃত্যুর পর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করা হয়। বাদ দেওয়া হয় শফীপন্থিদের। কিছুদিনের মধ্যেই কাসেমীর মৃত্যু হলে সিনিয়র নায়েবে আমির নুরুল ইসলামকে মহাসচিব করা হয়। এই কমিটিতে থাকা হেফাজত নেতারা শুরু থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় সভায়, ওয়াজ মাহফিলে সরকার, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগকে তীব্র আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলেন।

এর মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে গণমাধ্যমে। দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংসতায় হতাহত, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডবের পর হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এক পর্যায়ে ওই বছরের ২৫ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। তবে ৭ জুন বাবুনগরীকে আমির করে আবারও ৩৩ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ‘আগের তেজ হারিয়ে’ শুধু বাবুনগরীর নামে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড।

চারমাস পর ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট বাবুনগরীও মারা যান। এরপর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটি ও শূরা কমিটির এক নম্বর সদস্য মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে আমির করা হয়। অশীতিপর বৃদ্ধ মুহিবুল্লাহও দেড় বছর ধরে হেফাজতে ইসলামকে আর চাঙ্গা করতে পারেননি।

এ অবস্থায় সোমবার (৩১ অক্টোবর) সকালে হাটহাজারীর দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসায় মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মীর ইদরিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে গত দেড় বছর আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারিনি। আমরা কেন পারিনি, সেটা সবাই জানে ও বোঝে। কিন্তু এভাবে সাংগঠনিক কাজ তো বন্ধ রাখা যায় না। অতীতে যা হয়েছে, সেটাকে বাদ দিয়ে আস্তে আস্তে আমরা আগে বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমাদের তো কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। আমরা দ্বীনের জন্য কাজ করি। এই সরকার থাকলেও করব, ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার এলেও করব।’

দেড় বছর পর সরব হওয়ার নেপথ্যে সরকারের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে বোঝাপড়ার কোনো বিষয় নেই। পরিস্থিতি ও সুযোগ তৈরি হওয়ায় আমরা মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১৭ ডিসেম্বর আমরা ঢাকায় জাতীয়ভাবে উলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করব। সুযোগ থাকলে আমরা আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে নেব।’

হেফাজতের মাঠে নামার ‘পরিস্থিতি ও সুযোগ’ তৈরি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবং সন্তানরা মিলে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ি ঘেরাও করেছিলাম। সেখানে আমরা বলেছি, সরকার আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের চাপে রাজাকার-আলবদর ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মাঠে নামার সুযোগ দিচ্ছে। রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে সরকার গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি খেলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতের মতো একটা উগ্রবাদী সংগঠনকে মাঠে নামার পরিস্থিতি ও সুযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে সরকার একই খেলা খেলছে বলে আমরা মনে করি। আমরা একদিকে হেফাজতের উগ্রবাদীদের গ্রেফতার দেখেছি, অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও দেখেছি। এ ধরনের গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। দেশও জাতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।’

এদিকে হেফাজতের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বৈঠকে কারাবন্দি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে সহিংসতাসহ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নামে দায়ের হওয়া সকল মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী চিঠি দেবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে ব্যক্তিগত কাজে হেফাজতের পদ-পদবি ব্যবহার না করার জন্য দায়িত্বশীলদের সতর্ক করা হয়েছে।

জানতে চাইলে মীর ইদরিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে কর্মসূচি পালনের পর হেফাজতের প্রায় ৮০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭০০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছিল। চট্টগ্রামে ৮৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত দেড় বছরে ৭৫০ জনের মতো নেতাকর্মী জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন। আরও ৫০ জনের মতো জেলে আছেন। আমরা তাদের মুক্তি দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেব।’

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহনগর কমিটি সম্প্রসারণ এবং পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক মুহিউদ্দীন রাব্বানী ও দাওয়া সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম সোবহানীকে সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। কিফায়াতুল্লাহ আযহারীকে প্রচার সম্পাদক ও মাওলানা রাশেদ বিন নূরকে দফতর সম্পাদক করা হয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটিতে আরও যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন- আরশাদ রহমানী, আবদুল বাসির, শাহাদত হোসেন, খোবাইব, আশরাফ আলী নিজামপুরী, আবদুল কাদের, ইউনুস, শওকত হোসেন সরকার, সাঈদ নূর, আকরাম আলী, হেলাল উদ্দিন, নুরুল আবসার আজহারী, কেফায়েতুল্লাহ আজহারী, তৈয়ব হালীম, মাসুদুল করীম, নূরুর রহমান বেগ, নিজামদ্দীন, আবদুল মা’বুদ, মুসলিম, বোরহান উদ্দীন কাসেমী, আনওয়ার, কেফায়েতউল্লাহ, ইয়াহহিয়া, শাসমুল ইসলাম জিলানী, আব্দুল্লাহ পোরশা, শরিফ, তাফহিমুল হক, জুনাইদ বিন ইয়াহিয়া ও রাশেদ বিন নূর।

ঢাকা মহানগর কমিটিতে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন- মুহাম্মদ ফারুক, মুজিবুর রহমান হামিদী, লোকমান মাযহারী, আব্দুল্লাহ, ইউসুফ সাদিক হক্কানী, আব্দুল্লাহ ইয়াহিয়া, ইলিয়াস হামিদী, ওয়াহিদুর রহমান, যুবায়ের আহমদ, জসীমউদ্দীন, জুবায়ের রশিদ।

চট্টগ্রাম মহানগরে ১৭ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে তাজুল ইসলামকে এবং লোকমান হাকিম সদস্য সচিব। বাকি ১৫ জন হলেন- ফোরকানুউল্লাহ খলীল, আলী ওসমান, হারুন, মুনীর উদ্দিন, ইয়াসিন, হাসান মুরাদাবাদী, শিহাব উদ্দিন ইস্পাহানি, আনোয়ার রব্বানী, এনায়েতুল্লাহ, সায়েমুল্লাহ, ফয়সাল বিন তাজুল ইসলাম, জাকারিয়া মাদানী, জয়নাল কতুবী, শহিদুল ইসলাম এবং মানজুরুল কাদের।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠন করতে হেফাজতের বর্তমান মহাসচিব সাজিদুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি উপ-কমিটি করা হয়েছে। বাকি চারজন হলেন- মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মীর ইদরীস, আব্দুল কাইয়ুম সোবহানী ও কিফায়াতুল্লাহ আজহারী।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, নায়েবে আমির সালাউদ্দিন নানুপুরী, আব্দুল আউয়াল, জসিম উদ্দিন, ফুরকানুল্লাহ খলিল, শায়েখ সাজিদুর রহমান, মাহমুদুল হাসান ফতেহপুরী, জহুরুল ইসলাম, মুহিউদ্দিন রব্বানী, মীর ইদরীস, মোহাম্মদ আলী, আব্দুল কাইয়ুম সুবাহানী, কিফায়াতুল্লাহ আজহারী, সাইয়েদ মাহফুজ খন্দকার এবং রাশেদ বিন নূর।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

গা ঝাড়া মাঠ হেফাজতে ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর