যশোর: মুক্তেশ্বরী নদীর বিভিন্ন স্থানে নেটপাটা দিয়ে অবৈধভাবে দখল করেছে প্রভাবশালীরা। যশোর শহরসহ এর পশ্চিম পাশের ক্যান্টমেন্টের গা ঘেঁষে জগদীশপুর বাওরের পাশ দিয়ে শলুয়া বাজারসংলগ্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত অংশে এই দখলের ঘটনা ঘটছে।
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দখলদাররা মাছ চাষসহ নানা কাজে এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি এলাকাবাসীকেও নদীতে নামতে দেওয়া হয় না। অনেক জায়গায় প্রভাবশালীরা ভবন পর্যন্ত তুলেছে। এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। নদীকে প্রবাহমান করতে জেলা প্রশাসন বা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চলতি বছর কোনো উদ্যোগও নিতে দেখা যায়নি।
সরেজমিনে পুলের হাট থেকে মন্ডলগাতী অভিমুখে নদীর অনেক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোথাও কোথাও নদীর দু’পাশ দখল করে সরু করা হয়েছে। কোথাও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কোথাও নেটপাটা ও বাঁশের বেড়া দিয়ে নদীর প্রবাহ আটকে দিয়ে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নদীর প্রকৃত সীমানা যেমন চিহ্নিত নেই, তেমনি কে কোথায় কতটুকু দখলে আছে তারও পুরোপুরি হিসেব কেউ দিতে পারেনি। শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম দাবি করেছেন, গত বছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল।
দেখা গেছে মন্ডলগাতির উত্তর পাড়ায় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পর থেকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে নেটপাটা দিয়ে নদীকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানান, প্রাইমারি স্কুলের পাশ থেকে পুলের হাট পর্যন্ত নদী মুক্ত রয়েছে কিন্তু তার বিপরীত অংশ থেকে পাটা-খুঁটি দিয়ে অপর অংশে মাছ চাষ করছেন কয়েকজন। স্থানীয়রা তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করেননি।
তবে একাধিক সূত্র জানায়, একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থেকে রানা, লালু, ফিরোজ, রিপন, টিপুর নেতৃত্বে ওখানে মাছ চাষ করা হয়। যারা ওখানে মাছ চাষ করেন তারা স্থানীয়দের নদীতে নামতে দেন না। সবাই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ও ভয়ে তটস্থ রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দখলদাররা নদী লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। যদিও সরকারিভাবে কোনো নদী লিজ হয় না, তারপরও এখানে প্রভাবশালীরা করে খাচ্ছেন।
যদিও সরকার নদী রক্ষায় আইন করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ সংশোধনের উদ্দেশ্যে খসড়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সব নদী আইনি ব্যক্তি ও জীবন্ত সত্তা হিসাবে বিবেচিত। সেই সঙ্গে সব নদী পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিনের আওতায় হওয়ায় সেগুলো জনসম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে।
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, অন্য আইনে যা কিছুই বলা হোক না কেনো, নদীর দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, মৎস্য চাষ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া ফৌজদারি বিভিন্ন আইনের ধারা অনুযায়ীও শাস্তির বিধান রয়েছে এই আইনে। এমনকি নদীর প্লাবন ভূমি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে লিজ বা সাব-লিজ দেওয়া হলে, নদ-নদীর জরিপ, পর্চা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হলে, ডুবোচরকে চরে রূপান্তরের চেষ্টা, পানি প্রবাহে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতিসাধন ইত্যাদি করার চেষ্টা করা হলে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। নদীর ক্ষতি করে ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করা হলেও একই শাস্তি হবে।
নদী রক্ষায় এমন কঠোর আইন থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অন্তত মুক্তেশ্বরীতে নেই। এ ব্যাপারে নদী রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘মুক্তেশ্বরী নদী বহুস্থানে বহুজন নানাভাবে দখল করে আছে। সবাইকে উচ্ছেদ না করা হলে সংশ্লিষ্ট মূল নদীতে স্রোত ও প্রবাহমানতা থাকবে না। ভৈরবসহ আমাদের সব নদী ক্ষতির মুখে, একেবারে মৃত প্রায়। সরকার ও প্রশাসন সম্মিলিতভাবে নদীর অবৈধদখলদারদের উচ্ছেদ না করলে নদীর অস্তিত্ব থাকবে না।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলামও নদীকে লিজ দেওয়া যায় না এবং অবৈধ দখলদার থাকা উচিত নয় বলে জানান।
যশোর সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা র্নিবাহী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান জানান, এর আগে মুক্তেশ্বরীতে অভিযান চালানো হয়েছিল। একসময় লিজ দেওয়া হলেও তা পরবর্তীতে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের লিজ গ্রহীতারা উচ্চ আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে আবার মাছ চাষ করছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদালতের ওই আদেশ বাতিলের যে প্রক্রিয়া আছে তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তুষার কান্তি পাল বলেন, ‘নদীকে প্রবাহমান করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজ করছেন। তাছাড়া কোথাও নদী অবৈধদখলে থাকলে প্রশাসন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।’