Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘রামনাথ দিবস’ ঘোষণা, পাঠ্যপুস্তকে জীবনী অন্তর্ভুক্ত করার দাবি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ নভেম্বর ২০২২ ২২:৫২

ঢাকা: ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও জন্মবার্ষিকী ১৩ জানুয়ারিকে ‘রামনাথ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি।

মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) বিকেলে রামনাথ বিশ্বাসের মৃত্যুবার্ষিকীতে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক সেমিনারে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।

সেমিনারের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহেদ কায়েস।

তিনি বলেন, রামনাথ বিশ্বাস শুধু দুই চাকায় ঘোরাঘুরি করেননি। তিনি জনপদের পর জনপদকে জানার চেষ্টা করেছেন গভীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। তাই ১৩ জানুয়ারি সারাদেশের সব সাইক্লিস্ট গ্রুপ রামনাথকে যেন স্মরণ করে। কীর্তিমানের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা আয়োজন করবে বলে আমরা চাই।

তিনি আরও বলেন, যারা পাহাড়ে চড়তে ভালোবাসেন তাদের অনুরোধ করব, রামনাথের নামে কোনো একটি পাহাড় চূড়ায় যান সেদিন। ভ্রমণপিপাসুদের বলব দেশটাকে জানতে বেরিয়ে পড়ুন ও বিশ্বকে দেখুন। একইসঙ্গে সরকারের কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে রামনাথের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান থাকবে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর।

‘রামনাথ বিশ্বাস: বিশ্বজোড়া পাঠশালা তাঁর’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এই গবেষক বলেন, পৃথিবী বিখ্যাত ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, যিনি সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে সাত হাজার, রেলগাড়িতে দুই হাজার, জাহাজে ২৫ হাজার- মোট ৮৭ হাজার মাইল বা ১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন। রামনাথকে পাঠ করতে হবে। তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, সর্বকালের সেরা বিশ্ব ভূপর্যটকদের নাম লিখলে রামনাথ বিশ্বাসের নাম আসবে- এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বাঙালি জাতি ঘরকুনো, তারা ভ্রমণ করতে জানে না বিশ্বদরবারে- এ অপবাদ ঘুচিয়েছেন রামনাথ।

তিনি আরও বলেন, রামনাথ বিশ্বাস বিশ্ব পাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র। তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, দেখেছেন ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা; পরিচিত হয়েছেন বিপরীত সব রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। রামনাথ বিশ্বাস দু’চোখ ভরে উপভোগ করেছেন পৃথিবীর নানা রঙ, রূপ, রস। নবীন শিক্ষার্থীর মতোই আগ্রহ ভরে শিক্ষার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন। সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ঝুলি। ফলে গোটা জগৎ জুড়েই সৃষ্টি হয়েছিল তার পাঠশালা।

আহসানুল কবির বলেন, আমরা ভিনদেশি ইবনে বতুতাকে চিনি কিন্তু স্বদেশি রামনাথকে জানি না। আমরা ভিনদেশি সিরাজউদ্দৌলার জন্য অশ্রুপাত করি কিন্তু ভূমিপুত্র শমশের গাজীকে ডাকাত বলি। আমরা রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় সম্পর্কে জানি, কিন্তু এই মাটির সন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রামমুখর সাধনার কথা বলি না। একইভাবে আমরা হাজী মুহম্মদ মহসীনের দানশীলতার কথা বলি কিন্তু মহেশ ভট্টাচার্যের নামও উচ্চারণ করি না। এই দায় কার? রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা, আপনি-আমি-আমরা সবাই কমবেশি এর জন্য দায়ী।

সেমিনারে রামনাথকে উপনিবেশবাদবিরোধী উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক বলেন, রামনাথ বিশ্বাসের বই পাঠ করলে কেউ কখনোই ভুলতে পারবেন না। রামনাথ বিশ্বে ঘুরেছেন এবং চেয়েছিলেন কালো মানুষরা যেন জেগে ওঠে। আফ্রিকায় গিয়ে একেবারে মানুষের ভেতরে থেকে জীবন দেখেছেন। সেই দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই রামনাথ উপনিবেশবাদ বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, বানিয়াচংয়ে রামনাথের স্মৃতিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস যে মুছে ফেলা যায় না, সেটি রামনাথের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার স্পষ্ট হলো। মৌলভীবাজারে নীল রায়ের বসতভিটা, বানিয়াচংয়ে রামনাথের বসতভিটা এবং মানিকগঞ্জে বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্ত্রী প্রমীলার বাড়িও পুনরুদ্ধার করা হোক।

সেমিনারে সাবেক অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ বলেন, বানিয়াচংকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকল্পনা করার প্রতিশ্রুতি আছে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। রামনাথের নামে সেখানে মিউজিয়াম করার উদ্যোগ নিতে পারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।

সেমিনারে নিজের বক্তব্যে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা আলবদর পরিবারের দখলে থাকাটা লজ্জার বলে উল্লেখ করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এটা খুবই লজ্জার, আল বদর পরিবারের দখলে রয়েছে রামনাথের বসতভিটা। এই বসতভিটার পুরো জায়গাটিই পুনরুদ্ধার করার এই আন্দোলনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাশে থাকবে এবং যেখানে বলা লাগে বলবে। রামনাথের জায়গা পুনরুদ্ধার করতেই হবে।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ভূপর্যটক রামনাথের যে কৌতূহলের শেষ ছিল না তা তারই লেখাতে ফুটে উঠে। বাংলা সাহিত্যে অনেক ভ্রমণকাহিনী লেখককে আমরা চিনি, আমার নিজেরও বেশকিছু ভ্রমণবিষয়ক বই আছে। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাস যেখানে আলাদা- সেটি হলো তিনি ছিলেন একেবারেই সাধারণ একজন পর্যটক। যার কাছে ছিল না আড়ম্বরপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, প্রয়োজনের চেয়ে খুব বেশি অর্থও তিনি ভ্রমণের সময় সাথে নিতেন না। তার যেটি ছিল সেটি হচ্ছে অসম্ভব সাহস আর অসীম কৌতূহল।

রামনাথ বিশ্বাসের লেখার দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনী লেখার অসাধারণ হাতকে আমি আবিষ্কার করতে পারি- তার ‘তরুণ তুর্কী’ বইটি পড়ে। ততদিনে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে কামাল আতাতুর্ক সেখানে বিপ্লব করে ফেলেছেন। রামনাথ বিশ্বাসের ওই ভ্রমণকাহিনী পড়ে আমার মনে হয়েছে আমি যেন এক নতুন তুরস্ককে দেখছি।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল।

তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের বেদখল হওয়া বসতভিটার ১ একর ১৬ শতাংশ ভূমি উদ্ধারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়ে এসেছে। রামনাথ ছিলেন অকৃতদার। তার স্বজনদের কেউ আর নেই। তিনি বাংলাদেশের গৌরব। তাই তার স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।

এ সময় রামনাথের বসতভিটা উদ্ধারে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও বানিয়াচংয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তৎপরতা নিয়ে সেমিনারে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।

সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রুমা মোদক।

সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সাংবাদিক রাজীব নূর, দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু ও ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী। সেমিনারে রামনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে নিজের লেখা গান গেয়ে শোনান বাউল বশিরউদ্দিন সরকার।

উল্লেখ্য, হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রামনাথ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন চিরকুমার। তিনি বাইসাইকেলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরেছেন তিনবার। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণ-বিষয়ক ৪০টি বই। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় তিনি মারা যান।

বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় অনেক বড় এলাকা নিয়ে রামনাথের বসতভিটা। ৪ একর ৪৮ শতাংশ জমিতে বসতঘরের পাশাপাশি ছিল দৃষ্টিনন্দন মন্দির ও পুকুর। বর্তমানে পুরনো সব ভবন ভেঙে ফেলেছে দখলদার ওয়াহেদ মিয়ার পরিবার। শুধু মন্দিরের একটি অংশ এখনও টিকে আছে। সেটিও ধীরে ধীরে ভাঙা হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা জানান, রামনাথ ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল বাড়িটি। ১৯৮০-এর দশকে ওয়াহাব উল্লাহ নামে প্রভাবশালী একজন এই সম্পত্তি দখল করে নেন। ২০০০ সালের পর তিনি আবদুল ওয়াহেদের কাছে জায়গাটির দখল বিক্রি করেন।

আবদুল ওয়াহেদ ও তার বড় ভাই আবু ছালেকের দখলে সেই থেকে রয়েছে বাড়িটি। আবু ছালেকের বিরুদ্ধে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আর বাড়ির দখল নেয়ার সময় আবদুল ওয়াহেদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে আবু ছালেক এলাকা ছাড়েন। অন্যদিকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলে রাখতে আবদুল ওয়াহেদ নিজের নামে ভুয়া নামজারি করে নেন। তবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও রামনাথ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনলে সেই নামজারি বাতিল হয়।

আবদুল ওয়াহেদ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দারুজ্জামান খান বলেন, আবদুল ওয়াহেদের বড় ভাই আবু ছালেক এই এলাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি পলাতক।

স্থানীয়রা জানান, আবদুল ওয়াহেদ একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ির দখল ছাড়তে চাপ শুরু হলে স্থানীয় দুজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির হাত ধরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এখন তিনি ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। একজন দখলদার হিসেবে তিনি রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি দখল করে রেখেছেন। সরকারি খাতায় এটি অর্পিত সম্পত্তি।

সারাবাংলা/এসবি/আইই

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর