Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এখন পড়ালেখা হয় না, পরীক্ষার আগে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হয়’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৪ নভেম্বর ২০২২ ১৮:২৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেছেন, ‘প্রচলিত ব্যবস্থায় শিক্ষার চেয়ে এখন পরীক্ষা ‍গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। সেজন্য শিক্ষাটা স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। এখন বইয়ের চেয়ে নোটবই, শিক্ষকের চেয়ে কোচ, লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা এবং জ্ঞানের চেয়ে সনদপত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।’

শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সকালে ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক এক সেমিনারে আবুল মোমেন এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম নগরীর ফুলকি এ কে খান স্মৃতি মিলনায়তনে এ সেমিনারের আয়োজন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির মহাপরিচালক বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ ইমাম আলি এতে সভাপতিত্ব করেন।

বিজ্ঞাপন

দিনব্যাপী সেমিনারে তিনটি অধিবেশনে ‘শিশুর বিকাশ ও আমাদের শিশুশিক্ষা’ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাদর্শন ও মাধ্যমিক শিক্ষার চালচিত্র’ এবং উচ্চশিক্ষা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে শিক্ষাবিদ-গবেষক কানাই লাল দাশ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আব্দুল আউয়াল বিশ্বাস।

সেমিনারে আবুল মোমেন বলেন, ‘ষাটের দশকে একটি শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৪০-৪৫ জন শিক্ষার্থী থাকতো। স্বাধীনতার পর আশির দশকে একটা এনাম কমিশন হল, একটি শাখায় যদি ১২০ জন না হয়, তাহলে নতুন শাখা খোলা যাবে না। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিতে এক ক্লাসে ১২০ জন ছাত্র, এটা ভাবা যায় ? একজনের শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস নেয়া এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তোলা কোনোমতেই সম্ভব নয়।’

বিজ্ঞাপন

‘আবার শিক্ষকদের ওপর একটা চাপ আছে যে, ভালো ফলাফল দেখাতে হবে। ভালো ফলাফল দেখাতে হলে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তখন পরিস্থিতি তৈরি হল যে চার-পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর ভালো করে শিখলেই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা যাবে। এর চেয়ে বেশি শিখলে পরীক্ষায় বসে মনে থাকবে না। তখন অল্প জিনিস মুখস্ত করার বিষয়টা শুরু হয়ে গেল।’

পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীরা সাধারণত যা করে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়- আগামী দুই মাস পরীক্ষার জন্য আমি কোন রকম ফেসবুকে বসব না, সিনেমা দেখবো না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবো না, বাসার কোনো কাজ করবো না। নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে গিয়ে লিখে দিয়ে আসে এবং ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু রেজাল্টের পর কি পড়েছিল সেটা আর মাথায় থাকে না।’

শুধু পরীক্ষার জন্য মুখস্থ করা- এই পদ্ধতিতে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয় মন্তব্য করে আবুল মোমেন বলেন, ‘শিক্ষাটা পর্যায়ক্রমে হতে হবে। ওয়ান, টু, থ্রি- এভাবে করেই যেতে হবে। যদি মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেই সবকিছু হয়ে যায়, তাহলে তো একজন শিশুও শুরুর দিকের ক্লাসে না পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ফেলতে পারবে। এভাবে তো শিক্ষাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সামগ্রিকতাটা ভেঙে যাচ্ছে।’

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে কাজ করে যাওয়া আবুল মোমেনের মতে, শিক্ষার্থীকে শৈশব থেকে নিজের শিক্ষাটা নিজেকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষক হবেন ফ্যাসিলিটেটর। তবে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে আগাতে হবে।

‘শিক্ষার্থীকে নিজেকেই আগে তার প্রয়োজনীয় শিক্ষাটা নিতে হবে, শিক্ষক পরে। জন্তুজানোয়ার যদি পারে, হাঁসের বাচ্চা যদি দেখে দেখে সাঁতার শিখে যায়, মানুষের বাচ্চা পারবে না, এটা হতে পারে ? এই প্রক্রিয়ায় যদি শিক্ষাদান হয়, তাহলে নোটবই-গাইডবই কোনো ব্যাপার না। এটাকে তো আমরাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছি। এই যে পরীক্ষাটা মুখ্য হয়ে গেছে, সেজন্য শিক্ষা জিনিসটা স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে চলে গেছে, বইয়ের চেয়ে নোটবই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে, শিক্ষকের চেয়ে কোচ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে এবং লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে এবং জ্ঞানের চেয়ে সনদপত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।’- বলেন আবুল মোমেন

সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এফ ইমাম আলি বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন হয়েছে, তবে তা গুণগত মানের বিচারে নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাও গড়ে তোলা যায়নি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি এগুলো সম্পর্কে পড়াশোনা এবং জ্ঞান খুবই সীমিত অথবা নেই। এর ফলে দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ইহজাগতিকতা, সার্বজনীন-মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে।’

‘শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক দুর্নীতির খবর প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ক্রিয়াশীল। এটা জাতির জন্য লজ্জাকর। অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশ গড়ার সঙ্গে এই শিক্ষা ব্যবস্থা সাংঘর্ষিক। এটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক নাগরিকদের চিন্তার অবকাশ রয়েছে।’

সেমিানের আরও বক্তব্য রাখেন- রবীন্দ্রকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান মো.মজনুর রশীদ, সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. সুদীপ্তা দত্ত, বাকলিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. সিরাজুদ্দৌল্লা, যশোর সরকারি মাইকেল মুধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খ ম রেজাউল করিম এবং রাঙ্গুনিয়া হাসিনা জামাল ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্ত।

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ঢাকার পথে প্রধান উপদেষ্টা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৩

সম্পর্কিত খবর