Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুষ্টিহীনতায় দেশের ৬০ শতাংশ নারী!


২৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৯:৫৫

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।। 

ঢাকা: ময়মনসিংহের নূরজাহানের বিয়ে হয় ১৭ বছর বয়সে, ১৯ বছর বয়সেই মা হন তিনি। সন্তানের জন্মের পর মায়ের কাছে ছেলেকে রেখে স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়।

ঢাকায় আসার পর থেকে নূরজাহান গৃহকর্মীর কাজ করেন। ভোর ছয়টায় ঘর থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় ফেরেন মালিবাগের বস্তিতে তার খুপড়ি ঘরে।

নূরজাহান প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। যখন তখন তার মাথা ঘোরায়। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে হাসপাতালে ভর্তির পর জানা যায় তিনি অপুষ্টিতে ভুগছেন, শরীরে রক্তশূণ্যতা। একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা আসমা বেগমেরও।

ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশনাল সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রাম (এফএসএনএসপি) থেকে জানা যায়, দেশে আড়াই কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে, যার ৬০ শতাংশই নারী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতি বিষয়ক ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রাম এর গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তারা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতরে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে । একইসঙ্গে বাংলাদেশের মায়েদের এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টির শিকার এবং উচ্চতার তুলনায় তাদের ওজন কম বলেও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি।

এদিকে, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বর্তমানে অপুষ্টিতে ভুগছে, এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ। গত দশ বছরে অপুষ্টিত জনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে সাত লাখ। অথচ বাংলাদেশ ফুড প্ল্যানিং মনিটরিং ইউনিট থেকে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য। আর এই ১৬ বিলিয়ন ডলারের ভেতরে পুষ্টি উন্নয়নের জন্য খরচ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

সংগঠনটি বলছে, পুরো পরিস্থিতির ভেতরে নারী ও শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা প্রয়োজন অনুসারে খাদ্য পাচ্ছে না, যার কারণে পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। অপরদিকে, পুষ্টিহীনতার কারণে ৪২ শতাংশ নারী খর্বাকৃতি, ৩২ শতাংশ কিশোরী খর্বাকৃতি, ৪৪ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতা এবং শরীরে দীর্ঘমেয়াদি শক্তির ঘাটতি রয়েছে এমন নারীর সংখ্যা ২৫ শতাংশ এবং খাদ্যে কম অনুপুষ্টি গ্রহন করছে শতকরা ৬০ শতাংশ নারী।

সঠিক খাদ্য, সামগ্রিক পরিবেশ এবং বাল্যবিবাহ নারীদের অপুষ্টির প্রধান কারণ বলে মনে করেন খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মহসিন আলী । তবে এর সঙ্গে জলবায়ুর প্রভাব, জীবন জীবিকা এগুলোও জড়িত বলেন তিনি।

খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। যার মধ্যে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ অতি দরিদ্র। ধরেই নেওয়া হয়, দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী সকল মানুষ ২১২২ ক্যালোরি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাবার পায় না।

মহসিন আলী বলেন, মানুষ যেখানে খাবারই পায় না সেখানে পুষ্টির বিষয়টি আরও দূরে। অতিদরিদ্র এবং দরিদ্রদের মধ্যে নারীরা আরও বেশি অবহেলিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর জন্য আমাদের দেশের ইতিহাস বা সংস্কৃতিও কিছুটা দায়ী। কারণ পুরুষ বা ছেলেদের খাবারের বিষয়ে পরিবার যতটা গুরুত্ব দেয় মেয়ে বা নারীদের বিষয়ে পরিবার ততটা দায়িত্ব নেয় না। নারীদের মাছ ও দুধের মতো খাবার খাওয়া দরকার, সেটা কম হলেও। কিন্তু এ নারীরা অবহেলিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুষ্টির কারনে অন্যান্য ইন্ডিকেটরে রয়েছে শীর্ণতা, খর্বতা,কৃষকায়তা। আর এসবের বড় কারন-বাল্যবিবাহ।

বিজ্ঞাপন

মহসিন আলী বলেন, দেশে এখনও ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের। আর বিয়ের পর সন্তান প্রসবের জন্য যে শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার, শারীরিক যে কাঠামো দরকার সেসব কিছুই থাকে না এসব কিশোরীদের। প্রস্তত না হবার কারণে যখন সন্তান ধারণ করে তখন তার শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

প্রথমে মায়ের অপুষ্টি এবং পরে মা থেকে তার সন্তানও অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। এসব শিশুরা পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, পুষ্টিহীনতা নিয়ে বেড়ে ওঠে এবং বড় হয়। যার কারনে খর্বকায়, কম ওজন শীর্ণকায় হয়ে বড় হতে থাকে সন্তান।

বেশিরভাগ সময় চিকিৎসা নিতে আসা বয়স্ক থেকে কিশোরী সবাই অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং বিষয়টি চক্রকারে ঘুরছে মন্তব্য স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরীর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, নারীরা পুষ্টি নিয়ে অবহেলার শিকার হন, তাদের পুষ্টির বিষয়টি আমাদের দেশের পরিবারগুলোতে চিন্তাতেই নেওয়া হয় না। অথচ একজন নারী যখন সন্তান ধারণ করেন তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই পুষ্টি। কারণ একজন মা পুষ্টিকর খাবার খেলেই তার সন্তানটি পুষ্টি পাবে-তাই বলা যায় অপুষ্টির বিষয়টি দেশে চক্রাকারে ঘুরছে। একইসঙ্গে দরিদ্রতা ও অশিক্ষার কারনে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পুষ্টির দিকে নজরটাও কম থাকে পরিবারে বলেন ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পুষ্টিসেবা প্রোগ্রাম ম্যানেজার এস এম মুস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, বাল্য বিয়ে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, একজন কিশোরী যখন মা হয় তখন ‘সে বড় হবে নাকি তার ভেতরে থাকা বাচ্চা বড় হবে’ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর অপুষ্টির জন্য এটি প্রধান কারণ বলেন তিনি। অপরদিকে, পরিবারগুলোতে ব্যালেন্স ডায়েট এর বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে।

আবার শুধু কার্বোহাইড্রেড থেকে যেখানে ৬০ শতাংশের বেশি ক্যালোরি নেওয়া উচিত না সেখানে আমরা ৭০ শতাংশের বেশি ক্যালোরি নেই শুধু কার্বোহাইড্রেড থেকে। সুষম খাবাবেরর পরিবর্তে কার্বোহাইড্রেড বেশি খাওয়া এবং অসেচতনভাবে কেবল খাবার খাওয়াও নারীর অপুষ্টির অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, পুষ্টির মানদণ্ডে না খেয়ে বাংলাদেশের মানুষ তৃপ্তির মানদণ্ডে বেশি খায়। রন্ধণপ্রক্রিয়ার কারনে এবং তৃপ্তির কারণে  আমরা পুষ্টির মানদণ্ড বজায় রাখতে পারি না যার কারণে খাবারের গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়। সীমিত সম্পদের এই অসীম অপব্যবহারের কারণে পুষ্টি হারিয়ে যায় খাবার থেকে আর এর অন্যতম শিকার হন নারীরা- বলেন মুস্তাফিজুর রহমান।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর