ইভিএম কেনার প্রস্তাব ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন
১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৩২
ঢাকা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্ধেক আসনে ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে ৮ হাজার ৭শ ১২ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করে নির্বাচন কমিশন। প্রস্তাবটি পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনেও। এর প্রায় দুই মাস পর মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) প্রকল্পটি একনেক সভায় উঠলেও তা আবার ইসির কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবটি ফেরত পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন ফের কাজ শুরু করেছে। কমিশনের আশঙ্কা— ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন না হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, ইভিএম ক্রয়ের প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফেরত এসেছে। যতটুকু শুনেছি, পরিকল্পনা কমিশন টেকনিক্যাল কমিটি স্বাক্ষরিত নথিপত্র চেয়েছিল। তারা গত সপ্তাহে এটি নিয়ে বসেছিল।’
‘তবে থমকে যাওয়া না বা বাস্তবায়নের এখনও যথেষ্ট সময় আছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়েও যদি প্রকল্প অনুমোদিত হয় তাহলে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন মো. আনিছুর রহমান।
রোববার (১৩ নভেম্বর) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘ইভিএম কেনার বাজেটে কাটছাঁট হবে কিনা এ রকম কোনো ইঙ্গিতও আমরা পাইনি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে। সরকারের কাছ থেকে যে রকম অর্থ পাওয়া যাবে, আমরা সেভাবে ইভিএম সংগ্রহ করব। আমরা অর্থ বিভাগেও প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম সেটিও এখন পর্যন্ত ক্লিয়ার হয়নি। সেখানেও যোগাযোগ হয়েছে।’
ইসি কমিশনার বলেন, ‘সংরক্ষণাগার না থাকায় আগের বেশ কিছু ইভিএম অকেজো হয়ে গিয়েছে। সেগুলো মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ১০টি রিজিওনালে ১০টি ওয়্যারহাউস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী সরকার এটির অনুমোদন দেবে।’
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা ১৪৫টি ভোটকেন্দ্র সম্পর্কে তদন্ত করতে বলেছি। তদন্ত কমিটি কাজ করছে, আগামীকাল তারা কমিশনে রিপোর্ট জমা দেবে। রিপোর্ট দেখে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের সহায়তা নিয়েই আমরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও সংশোধন বা আইনের সংস্কারটা শেষ করতে পারব। তবে সরকারের সহায়তা না পেলে আমাদের সর্বশেষ ভরসা মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তখন আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে বলতে পারব, এই জায়গাটায় ঠেকে আছি আপনি কিছু করেন। তবে রাষ্ট্রপতির বিষয়টি আমরা এখনও চিন্তা করছি না।’
আরপিও সংশোধন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যস্ততার জন্য বা বিভিন্ন কারণে হয়তো আরপিও সংশোধনীতে একটু দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। আমার ধারণা অচিরেই সরকারের তরফ থেকে একটি ফলাফল পাব।’
তিনি বলেন, ‘এই পর্যন্ত আমাদের দায়িত্বকাল সাড়ে আট মাস হচ্ছে। সাড়ে আট মাসে কোনোরকম চাপ, কোনোরকম অসহযোগিতা আমরা পাইনি। সরকারের কাছ থেকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতামূলক আচরণ পেয়ে আসছি।’
সাড়ে আট মাসে আপনাদের প্রতি বিরোধীপার্টির আস্থা বেড়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি আনিছুর বলেন, ‘সেটি আপনারা ভালো বলতে পারবেন। আপনাদের সঙ্গে সরকার এবং বিরোধী দল উভয়পক্ষের ইন্টারকানেকশন বেশি হয়। সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা সরাসরি বিরোধী পক্ষের কাছে যেতে পারছি না।’
সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা আশাবাদী, সব দল নির্বাচনে আসবে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে রাজনীতিতে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। সময় অনেক কিছু বলে দেবে। আমাদের একটিই চ্যালেঞ্জ সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। আমরা সফল হবো কিনা জানি না, তবে আমাদের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা থাকবে।’
‘নির্বাচনি ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার টাকার এই প্রকল্প গত ১৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন অনুমোদন দেয়। পরে প্রকল্পটি প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা একনেকে অনুমোদনের জন্য ১৯ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রস্তাবটি পাঠানোর প্রায় দুই মাস পর গত ৯ নভেম্বর একনেক সভায় উঠলেও তা ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। এতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেড়শো আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন করানা গেলে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ইসির প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, শুধু ইভিএম কেনায় খরচ হবে ৬ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইভিএম সেন্টার স্থাপন, অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউজ নির্মাণ, ইভিএম সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় খরচ হবে ৬৯০ কোটি টাকা। প্রকল্পে প্রতিটি ইভিএম কেনার দাম ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে যে মেশিন কেনা হয়েছিল ২ লাখ ১০ হাজার টাকা করে, সেটি এখন কেনায় অতিরিক্ত খরচ হবে ১ লাখ টাকার বেশি। বর্তমানে চলমান প্রকল্পে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়েছে। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
এ ছাড়াও ইসির প্রস্তাবিত প্রকল্পে নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইভিএমে ভোটগ্রহণে দক্ষতা বৃদ্ধি, ভোটার শিখন, ইভিএম নিয়ে জনসচেতনতা ও দেশব্যাপী ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রচার চালাতে ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা ও নিরাপত্তার সামগ্রী ভাড়া বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা। এতে ২ লাখ ২৫ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরার ভাড়াসহ সংযোগ সেট করার খরচ ধরা হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। সিসিটিভি স্থাপনে খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা। সিসিটিভি ক্যামেরার জন্য আইএসপি সংযোগে ১০ কোটি ও কেবল সংযোগে ১১ কোটি টাকা খরচ হবে। এই প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিংয়ের জন্য ১ হাজার ১৩৫ জনবল নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য বেতন ভাতা বাবদ ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ২৬৪ কোটি টাকার যানবাহন কেনা, যানবাহন নিবন্ধন ও নবায়ন ফি ১৬ কোটি টাকা, পেট্রল খরচ ৯১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া আলাদা করে প্রশিক্ষণে ৫২ কোটি টাকা, ওয়্যারহাউজ নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণে ৪০ কোটি টাকা, ১০টি ওয়্যারহাউজ নির্মাণে ৩৭০ কোটি টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যারে ২২ কোটি, আসবাব ও ওয়্যারহাউজের র্যাক কেনায় ৫৬ কোটি টাকা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও থার্মাল কন্ট্রোল কেনায় ১১০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
ইভিএমে ভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। ইসির কাছে এখন দেড় লাখ ইভিএম আছে। এরমধ্যে অনেক আছে অকেজো। বাকি ইভিএম দিয়ে ৬০-৭০টি আসনে ভোট করা যাবে। ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণ করতে আরও ২ লাখ ইভিএম দরকার।
গত আগস্টে ইসির সংলাপে ২২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দেয়। আরও পাঁচটি দল ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কথা বলেছে। কেবল আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে।
সারাবাংলা/জিএস/একে