চট্টগ্রাম ব্যুরো: ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিনতাইয়ের জন্য ‘শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী’ চালককে খুন করে লাশ গুম করে রাখা হয় ডোবায়। সেই লাশ উদ্ধারের পর স্থানীয় থানার পুলিশ নানাভাবে চেষ্টা করেও তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি। পুরোপুরি সূত্রবিহীন ওই ঘটনা নিয়ে ছায়া তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে খুন হওয়া চালকের পরিচয় এবং খুনের সঙ্গে জড়িত দুই তরুণকে গ্রেফতার করেছে, যারা পেশায় পরিবহন শ্রমিক।
নগরীর কোতোয়ালী থানার লালদিঘীর পাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে গতকাল শনিবার (১২ নভেম্বর) রাতে দুই পরিবহন শ্রমিককে গ্রেফতার করে পিবিআই। তারা হলেন— মো. আলাউদ্দিন (২৮) ও শাকিল আহমদ (১৯)।
এর আগে, ৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শপাড়া এলাকায় রাস্তার পাশে একটি ডোবা থেকে প্রায় অর্ধগলিত অবস্থায় আনুমানিক ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার ডান হাত ছিল না। বাম হাত পেছন থেকে পেঁচিয়ে গলার সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি একেবারেই ক্লুলেস ছিল। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করি। এরপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত দু’জনকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটিকে তারা নৃশংসভাবে খুন করা হয়।’
যেভাবে লাশের পরিচয় মেলে:
অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানার পরপরই ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই। লাশের ছবি এবং ঘটনাস্থলের অদূরের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পিবিআই দেখতে পায়, লাশ উদ্ধারের দুইদিন আগে ৭ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে লাশ উদ্ধারের ঘটনাস্থল আদর্শপাড়ার সড়ক দিয়ে দু’টি সিএনজি অটোরিকশা ঢোকে এবং বের হয়। একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা ঢুকলেও বের হওয়ার দৃশ্য ফুটেজে নেই। আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ওই রিকশাচালকের ডান হাত নেই। তখন পিবিআই নিশ্চিত হয়, নিহত ব্যক্তি রিকশাচালক।
পরিচয় শনাক্তের প্রক্রিয়ার মধ্যে পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক মৃত ব্যক্তির ছবি দেখে তাকে চিনতে পারেন। মৃত ব্যক্তি মো. হাসান (৪৫) নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার রাজাখালী এলাকায় মাস্টার কলোনিতে তার বাসা ছিল। বাড়িতে তার স্ত্রী ও চার ছেলে আছে।
পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসানের বাড়ি আর আমার বাড়ি এক কিলোমিটারের মধ্যে। চার বছর আগে তার ডান হাতে একটি টিউমার হয়, পরে সেটা ক্যান্সারে পরিণত হয়। তখন হাসপাতালে তার ডান হাত কেটে ফেলা হয়। এক হাত নিয়ে সে গ্রামে গিয়ে এলাকায় নানা বিষয়ে মাইকিং করাকে পেশা হিসেবে নেয়। কিন্তু উপার্জন ভালো না হওয়ায় পরের বছর সে চট্টগ্রাম শহরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে কিছু টাকা এনেছিল। আমিও কিছু আর্থিক সহযোগিতা করে যেহেতু সে প্রতিবন্ধী, তাকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দেই।’
‘রাজাখালী এলাকায় একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক জামাল মিস্ত্রি আমাদের গ্রামের বাসিন্দা। জামাল মিস্ত্রি তাকে একটি বিশেষভাবে রিকশা তৈরি করে দেন, যেটার গিয়ার বামদিকে, যেহেতু তার ডান হাত নেই। হাসান জামাল মিস্ত্রির বাসায় ভাত খেত ও পাশের একটি কক্ষে একা থাকত। ৩ নভেম্বর তিনি ব্যক্তিগত একটা কাজে আমার অফিসে এসেছিলেন। এরপর ৮ নভেম্বর গ্রাম থেকে তার ভাতিজা আমাকে ফোন করে জানায়, হাসানকে পাওয়া যাচ্ছে না, মোবাইলও বন্ধ। আমি তাকে দিয়ে প্রথমে বাকলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করাই। পরদিন অফিসে গিয়ে আমি লাশের ছবি দেখে হাসানকে শনাক্ত করি।’
এবার ‘খুনি’ শনাক্তের পালা:
লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর জড়িতদের ধরতে একাধিক টিম গঠন করেন পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। হাসানের খোয়া যাওয়া মোবাইলের অবস্থান এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাইয়ের দায়িত্ব পড়ে পিবিআই পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিনের ওপর। তিনিই হত্যাকাণ্ডে দু’জন জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে একপর্যায়ে তাদের অবয়ব শনাক্ত করেন।
পিবিআই পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মোট ৪৮টি পয়েন্টের শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। আদর্শপাড়ার যে স্থান থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে সেখানকার ৭ নভেম্বর রাতের ফুটেজে দেখা গেছে, ডান হাতবিহীন চালকের রিকশায় দু’জন যাত্রী। তবে তাদের ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে হাসানের মোবাইলের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। মোবাইলটি ৭ নভেম্বর রাত থেকে নগরীর লালদিঘীর পাড়, কোতোয়ালী, শাহ আমানত সেতু, আদর্শপাড়া, ফকিরনির হাট, সিইউএফএল ঘাট হয়ে কর্ণফুলী নদীর শহরের অংশে পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট এবং আবার লালদিঘীর পাড়ে সেটির অবস্থান পাওয় যায়।’
পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা জানান, মোবাইলের অবস্থানের ভিত্তিতে প্রত্যেকটি স্পটের ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা যায়, নগরীর সিনেমা প্যালেসের মোড়ে টেকনাফ বাস কাউন্টারের সামনে রিকশা চালক হাসান। একই রাতে আবার রিকশাসহ তার অবস্থান শনাক্ত হয় আদর্শপাড়া এলাকায়। ওই রিকশার দুই যাত্রীকে মোবাইলে যেসব স্পট শনাক্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রায় প্রতিটিতে দেখা যায়। তবে পুরোপুরি অবয়ব শনাক্ত হয়েছে পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে।’
‘যাত্রী আলাউদ্দিনের পায়ে জুতা ছিল না। শাওনের গেঞ্জিতে লেখা ছিল ইংরেজিতে- এভরিডে। কয়েকটি স্পটের ফুটেজে এই দু’টি চিত্র পাওয়া যায়। সেটিকেই আমরা সূত্র হিসেবে ধরে আগাতে থাকি। ১৫ নম্বর ঘাটের ফুটেজে এই দু’জনের চেহারা পুরোপুরি শনাক্ত করি। যেহেতু মোবাইলের সর্বশেষ অবস্থান লালদিঘীর পাড়, আমরা গত (শনিবার) রাতে ওই এলাকায় অবস্থান নেই। একজনকে গণশৌচাগারের প্রবেশসপথে একটি চৌকিতে শোয়া ও আরেকজনকে সেখানে বসা অবস্থায় পাওয়া যায়’- বলেন ইখতিয়ার উদ্দিন।
কেন-কিভাবে এই হত্যাকাণ্ড?
পিবিআই জানিয়েছে, গ্রেফতার দু’জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়। আলাউদ্দিনের বাড়ি আদর্শপাড়া এলাকায় যেখান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার থেকে আনুমানিক ২০০ গজ দূরে। শাওনের বাড়ি কুমিল্লায়। আলাউদ্দিন গাড়ি চালাতে পারে। শাওন লালদিঘীর পাড়ের মাইক্রো স্ট্যান্ডে গাড়ি পরিষ্কার করে। তবে তিনি গাড়িচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ খুঁজছিলেন।
পিবিআই পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আলাউদ্দিনের আরাকান সড়ক পরিবহন সমিতির কার্ড প্রয়োজন গাড়ি চালানোর জন্য। এজন্য তার সাড়ে ৭ হাজার টাকা দরকার। আর হেলপার হিসেবে কাজ করার জন্য শাকিলের শিক্ষানবিশ চালক সনদের প্রয়োজন। এজন্য তারও টাকার দরকার। সেই টাকার যোগান দিতে উভয়ে মিলে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। সিনেমা প্যালেসের মোড় থেকে ৩০০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে তারা যায় আদর্শপাড়া এলাকায়।’
পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, ‘আদর্শপাড়ায় গিয়ে রিকশা থামিয়ে হাসানকে চলে যেতে বলে দু’জন। তখন হাসান বুঝতে পারেন যে তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তিনি রিকশায় থাকা একটি কাঠের টুকরা দিয়ে শাকিলকে আঘাত করেন। ডান হাত না থাকায় একটি বেল্টের সঙ্গে রিকশার হ্যান্ডল বেঁধে ওই হাতের দিকে জোর এনে চালাতেন হাসান। কাঠ দিয়ে আঘাতের পর শাকিল ও আলাউদ্দিন মিলে সেই বেল্ট খুলে তার বাম হাত পেছন দিয়ে নিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে। এরপর লাশ ডোবায় ফেলে বেতপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। দুইদিন পর ৯ নভেম্বর দুর্গন্ধ পেয়ে স্থানীয়রা লাশটি দেখেন এবং পুলিশকে খবর দেন।’
পিবিআই পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিকশা নিয়ে আলাউদ্দিন ও সুমন ক্রসিং পার হয়ে আনোয়ারার রাস্তা দিয়ে ফকিরনীর হাট এলাকায় যায়। সেখানে একজন ব্যক্তির কাছে আলাউদ্দিন আগেও ছিনতাই করা রিকশা বিক্রি করেছিলেন। ভোরে সেই ব্যক্তির কাছে এই রিকশা নিয়ে গেলে তিনি তাদের লাঠি নিয়ে তাড়া দেন। কারণ আগে কেনা রিকশার জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। তাড়া খেয়ে সেখানে রিকশা ফেলে দু’জন সিইউএফএল ঘাট হয়ে ১৫ নম্বর ঘাটে উঠে। তাদের কাছ থেকে মোবাইল সেটটি উদ্ধার করা হয়েছে। রিকশাটিও উদ্ধার করা হয়েছে।’
গ্রেফতার দু’জনকে কর্ণফুলী থানায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।