Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ফতোয়া’ দিয়ে মেয়েকে হত্যা: ‘পীরবাবা’র বিরুদ্ধে ছেলের সাক্ষ্য

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: নিজের মেয়েকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগে দায়ের হওয়া একটি মামলায় কথিত এক পীরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিচার চলছে আদালতে। ১৩ বছর আগে দোররা মারার ফতোয়া দিয়ে মেয়েকে পিটিয়ে খুন করে লাশ গুমের ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে কথিত ওই পীরের বিরুদ্ধে দাঁড়ান নিজের স্ত্রী-সন্তানরা।

উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে কথিত পীরের করা আবেদনের কারণে মামলাটির বিচারকাজ প্রায় সাত বছর আটকে ছিল। পরবর্তীতে আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দিলে গত অক্টোবর থেকে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আমিরুল ইসলামের আদালতে আবার বিচার শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

গত ১৭ অক্টোবর মামলার বাদী কথিত পীরের ছেলে আবু দারদা আদালতে প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। সোমবার (১৪ নভেম্বর) আসামিপক্ষের আইনজীবী তাকে জেরা করেন। জেরা চলমান অবস্থায় আদালত এই মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ১৯ জানুয়ারি সময় নির্ধারণ করেছেন বলে বাদিপক্ষের আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান জানিয়েছেন।

মামলার আসামিরা হলেন- কথিত পীর মোহাম্মদ আব্দুল মতিন (৭৮) ও তার স্ত্রী ডা. শাহিদা বেগম (৫৩), ভাই মোহাম্মদ আব্দুস সবুর (৬৮) ও ছোট বোন বিনু বেগম (৫৩) এবং পীরের ‘সেবাসঙ্গী’ নার্গিস বেগম (৪৫)।

২০০৯ সালের ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার গ্রীণভিউ আবাসিক এলাকায় কথিত পীর আব্দুল মতিনের আস্তানায় নির্মম খুনের শিকার হন তার মেয়ে ২৩ বছর বয়সী উম্মে হাফসা। এ ঘটনায় পাহাড়তলী থানা মামলা না নেওয়ায় মতিনের ছেলে হাফসার বড় ভাই আবু দারদা আদালতের দ্বারস্থ হন। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় তিনি আদালতে নিজের বাবাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আদালত সংশ্লিষ্ট থানাকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন।

বিজ্ঞাপন

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, কথিত পীর মতিন তার চার মেয়ে উম্মে হাবিবা, উম্মে হাফসা, উম্মে আয়শা ও উম্মে রুম্মানকে বিয়ে না দিয়ে ‘তাপসী রাবেয়া বসরী’ বানিয়ে নিজের মতবাদ প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু উম্মে হাবিবা এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে তার ফুপাতো ভাই রোজিন রহমানকে বিয়ে করে পীরের আস্তানা থেকে পালিয়ে যায়। এতে সহায়তা করার অভিযোগে তিন মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে গৃহবন্দী রেখে দোররা মেরে হত্যার ফতোয়া দেন মতিন।

মতিনের নির্দেশে ও উপস্থিতিতে ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে হাফসা, আয়শা ও রুম্মানকে অনাহারে রেখে অন্যান্য আসামিরা দোররা মারতে থাকে। মোটা বেত দিয়ে থেমে থেমে দিনভর পেটানোর ফলে রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে আয়শা ও রুম্মান। তাদের অজ্ঞাতস্থানে সরিয়ে হাফসাকে রাতভর থেমে থেমে পেটানো হয়।

পরদিন সকাল ৭টার দিকে তার মুখ কাপড় দিয়ে এবং দুই হাত পেছন থেকে শেকল দিয়ে বেঁধে উপর্যুপরি দোররা মারতে থাকে। নির্মমভাবে মারধরের একপর্যায়ে হাফসা মারা যান। তখন হাফসার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে মতিন বলেন- তুমি একজন শহীদের গর্বিত মা। পরে নিহত হাফসাকে গোপনে আস্তানার মালখানার ভেতরে কবর দেওয়া হয়।

বাদীর আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আদালতে দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় আনা অভিযোগকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ উল্লেখ করে ২০১০ সালের ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পাহাড়তলী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোস্তফা কামাল। এর বিরুদ্ধে বাদী আবু দারদা নারাজি আবেদন দাখিল করলে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য নগর গোয়েন্দা পুলিশকে নির্দেশ দেন।

আদালতের নির্দেশে নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী অধিকতর তদন্ত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল দণ্ডবিধির ৩৪২, ৩২৩, ৩৫৪, ৩০২, ২০১ ও ৩৪ ধারায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়ে মহানগর হাকিম আদালত থেকে দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর হয়।

২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি মতিনসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। কিন্তু মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি মতিন উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। চার বছর পর ২০১৯ সালের ১৪ মে উচ্চ আদালত সেই আবেদন খারিজ করে ছয় মাসের মধ্যে বিচারকাজ ‍শুরুর নির্দেশনা দেন। এর ভিত্তিতে গত অক্টোবর থেকে ফের বিচারকাজ শুরু হয়েছে।

জিয়া হাবিব আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মতিনের চার স্ত্রী ও তাদের ঘরে ২৪ সন্তান। সে নিজেকে মহিলাদের মুরিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সারাদেশে তার কয়েক হাজার মুরিদ ছিল, যার মধ্যে অধিকাংশই এমবিবিএস ডাক্তার। এর মধ্যে এক ডাক্তারকে সে বিয়েও করে। এছাড়া কথিত সেবাসঙ্গী রেখে অনৈতিক কাজ করত আরও অনেকের সঙ্গে। এ নিয়ে স্ত্রীরা প্রতিবাদ করলে তাদের দোযখের ভয় দেখাত। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ফতোয়ার অপব্যাখা দিয়ে সে নিজের মেয়েকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি।’

সারাবাংলা/আরডি/ইআ

পীর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর