ডিআইজির ‘চক্রান্তে’ মক্কায় জেল খাটছেন বাংলাদেশি নাগরিক
১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৫৮
ঢাকা: বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজির (সিটি এসবি) চক্রান্তে সৌদি আরবের মক্কায় জেল খাটছেন বাংলাদেশি নাগরিক রাজ্জাক ওরফে হাবীবুর রহমান ইবাদত। প্রায় দুই বছর ধরে জেলখানায় প্রহর কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভাগ্নি তানজিলা হক ঊর্মির সাবেক স্বামী রাজ্জাক ওরফে হাবীবুর রহমান ইবাদত। ভাগ্নির উপকারের জন্য নিজের প্রভাব খাটিয়ে ইন্টারপোলেও রেড নোটিশ জারি করিয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। ওই রেড নোটিশ আমলে নিয়ে সৌদি আরবের পুলিশ হাবীবকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। যদিও হাবীবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সত্যতা পায়নি সৌদি আরবের পুলিশ। পাসপোর্ট ও ন্যাশনাল আইডিতে নামের জটিলতায় কারাগার থেকে সহজে মুক্তি ঘটছে না তার।
পাসপোর্টে হাবীবুর রহমান ইবাদতের নাম রাজ্জাক। পাসপোর্ট নম্বর-ইবি০১৮৩১৬১ এবং বিসি০৪৯৪৭৫৪। ১৯৯৮ সালে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান। তিনি একজন প্রথম সারির রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
২০২১ সালের ১৭ মার্চ তিনি হঠাৎ করে সৌদি ইন্টারপোল পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর তিনি জানতে পারেন, সাবেক স্ত্রীর মামা পুলিশ কর্মকর্তা অ্যাডিশনাল ডিআইজি (সিটি এসবি) শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল ইন্টারপোলে সন্ত্রাস, হত্যা, অর্থ পাচার, পাসপোর্ট জালিয়াতি ও ভিসা জালিয়াতিসহ নানান মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেড নোটিশ জারি করা হয়। রেড নোটিশটি একটি ই-মেসেজে সৌদি আরবের পুলিশকে দিলে হাবীবুর রহমান ওরফে রাজ্জাক গ্রেফতার হন।
হাবীব আরও জানতে পারেন, তার সাবেক স্ত্রী (ডিভোর্স) তানজিলা হক ঊর্মি ঢাকার আদালতে একটি নারী নির্যাতনের মামলা করেছেন। সেই মামলার পরোয়ানাও ঢাকা ইন্টারপোল থেকে সৌদি আরবের ইন্টারপোলে পাঠানো হয়।
রাজ্জাক ওরফে হাবীবের অভিযোগ, ঊর্মির সঙ্গে হাবীবের ডিভোর্সের এক বছর পর নারী নির্যাতনের একটি মিথ্যা মামলা করেন।
হাবীবের পরিবারের অভিযোগ- হাবীব কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নন যে, তার নামে ইন্টারপোলকে দিয়ে রেড নোটিশ জারি করে সৌদি আরবে গ্রেফতার করতে হবে। নারী নির্যাতনের মামলাটির বিষয়ে অবহিত হলে তিনি আদালতে নিশ্চয় হাজিরা দিতেন। কিন্তু তা না করে তাকে সৌদি আরবের মক্কার সামিছি কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। হাবীবের সহায় সম্পত্তি ভোগ দখল করতেই মূলত তাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন পরিবার।
ভুক্তভোগী হাবীবের বাবা অ্যানজেল শেখ অভিযোগ করে বলেন, উর্মির মামা শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল বর্তমানে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি। তার ক্ষমতাবলেই তানজিলা হক ঊর্মি এ সব ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতনের মামলায় পরিবারের সবাইকে হয়রানি করা হচ্ছে।
হাবীবের ইমাদ পরিবহন নামে একটি বাস কোম্পানিও রয়েছে। সেই কোম্পানির নামেও একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ সবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ঊর্মির মামা রফিকুল ইসলাম শিমুল।
অভিযোগ পাওয়ার পর গত চার মাস ধরে অনুসন্ধান করে সারাবাংলা। অনুসন্ধানে পাওয়া ডকুমেন্টস সারাবাংলার হাতে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালত হাবীবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ইন্টারপোল রেড নোটিশ (এ-২৭/১-২০২১) রিয়াদে পাঠায়। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ সৌদি আরবের পুলিশ কর্মস্থল থেকে হাবীবকে গ্রেফতার করে।
এরই ফাঁকে পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম শিমুল হাবীবের নামে নানা মিথ্যা অভিযোগ লিখিত আকারে সৌদি পুলিশের কাছে পাঠান। এরমধ্যে হাবীবের বিরুদ্ধে আবাসিক ঠিকানা জালিয়াতি করে সন্ত্রাসী, মানিলন্ডারিং ও মানব পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ করেন শিমুল। এছাড়া হাবীবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, ভিসা জালিয়াতি এবং পাসপোর্ট জালিয়াতির মতো অভিযোগও করেন শিমুল।
২০২১ সালের ৯ জুন জেদ্দার বাংলাদেশি কাউন্সেলর (শ্রম) ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানান যে, হাবীব ওরফে রাজ্জাক গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি আল নুজহা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই শেষে ২০২১ সালের ১ নভেম্বর ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে আরেকটি মেসেজ দিয়ে এনসিবি রিয়াদকে জানানো হয় যে, তার রেড নোটিশটি ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ক্যানসেল করা হয়েছে।
নোটিশে আরও বলা হয়, রাজ্জাক সোবহান তার পাসপোর্ট নাম এবং হাবীবুর রহমান ইবাদত তার সংক্ষিপ্ত নাম। এরপরও হাবীব জেল থেকে ছাড়া পাননি। এর কারণ জানতে সৌদি আরবের জেদ্দায় রাজ্জাক ওরফে হাবীবের আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়।
গত ১৯ অক্টোবর সৌদি আরবের আইনজীবী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সারাবাংলাকে বলেন, রাজ্জাক ওরফে হাবীবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, হত্যা, মানি লন্ডারিং, মানব পাচার, আবাসিক ঠিকানা জালিয়াতি, ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির রিপোর্ট করেছিল ঢাকা পুলিশ। দীর্ঘ তদন্তে এসবের কোনো কিছুই পায়নি সৌদি পুলিশ। এখন তিনি জেলে আটকা আছেন তার মূল কারণ নামের সমস্যা নিয়ে। পাসপোর্টে থাকা নাম ও এনআইডিতে থাকা নাম এক নয়। উচ্চ আদালতে আমরা আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েছি এ জন্য যে, দুই নামের ব্যক্তি একজনই।
হাবীব গ্রেফতার হওয়ার পর তার অধীনে থাকা বাঙালি শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের রেমিট্যান্স আসা তো দূরের কথা, এখন তাদের দেশে ফেরত আসার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
হাবীব সৌদি আরবের জেল থেকে ফোন করে এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট রাজ্জাক নামেই। সেটি মামা শ্বশুর রফিকুল ইসলাম জানতেন। সেই পাসপোর্টে জরুরি যোগাযোগের নাম ও নম্বর শেখ রফিকুল ইসলাম ছিল। ঊর্মির পাসপোর্টে স্বামীর নাম রাজ্জাকই ছিল। ওই পাসপোর্ট দিয়েই উর্মি সৌদি আরবে গেছেন এবং থেকেছেন। রফিকুল ইসলাম শিমুল এটির সুযোগ নিয়েছে। এর আগেও এই অনৈতিক সুযোগ নিতে পাসপোর্ট আটকে রেখেছিলেন তিনি।’
জানা যায়, ২০০৭ সালের ২৭ আগস্টে হাবীবুর রহমানের সঙ্গে তানজিলা হক ঊর্মির বিয়ে হয়। বিয়ের পর রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ফ্ল্যাট কিনে সেখানে রাখেন ঊর্মিকে। এক পর্যায়ে ঊর্মিকে সৌদি আরবে নিয়ে যান হাবীব।
ঊর্মি সৌদি আরবে থাকাকালীন হাবীবের ড্রয়ার থেকে টাকা সরিয়ে তার মামা রফিকুল ইসলাম শিমুলের ডাচ-বাংলা অ্যাকাউন্টে ২৭ লাখ টাকা পাঠান। যা হাবীবের অগোচরেই হয়েছে। পরে বিষয়টি জানার পর স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
মিরপুরে বাড়ি কেনার নামে ঊর্মি আত্মসাৎ করেছেন ৭০ লাখ টাকা। প্রিয় প্রাঙ্গণে প্লট কেনার নামে আত্মসাৎ করেছেন আরও ৫০ লাখ টাকা। আত্মসাৎ করা এসব টাকা ফেরত চাইলে হাবীবের পাসপোর্টটি বিমানবন্দর এসবি পুলিশকে দিয়ে আটকে রাখেন রফিকুল ইসলাম। আত্মসাৎ করা টাকার দাবি ছেড়ে দিলে প্রায় এক বছর পাসপোর্টটি ফেরত পান হাবীব।
সন্তানদের নিয়ে ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে (রোড-১, বাসা-৫, ফ্ল্যাট-সি) বসবাস শুরু করেন ঊর্মি। এক পর্যায়ে হাবীব বাচ্চাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাসায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা লাগানোর সময় ভাঙচুর করে ঊর্মি ওই সময় হাবীবকেও মারধর করা হয়।
এমনকি ঘটনার বিষয়ে সে সময়ের এসপি মামাকে নালিশ করলে মামা ন্যায়বিচার না করে হাবীবকে হুমকি-ধমকি দেন। দেওয়া হয় ক্রসফায়ারের হুমকিও।
২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঊর্মি ডিভোর্স নোটিশ পাঠান। একই বছরের ৫ মার্চ এক সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তিন বাচ্চা নাবালক হওয়ায় বৈঠকে ভরণ পোষণ বাবদ ঊর্মিকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ঊর্মির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে আসছেন হাবীব ও তার পরিবার। ডিভোর্স সম্পন্ন হওয়ার পর তৎকালীন এসপি মামার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে হাবীবসহ পরিবারের ৭ সদস্যের নামে ২০২০ সালের ৩ মার্চ ধানমণ্ডি থানায় নারী নির্যাতন মামলা করেন। এসপি মামার ক্ষমতায় দখল করেছেন ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটটি।
এমনকি হাবীবের ব্যক্তিগত গাড়িটিও (ঢাকা মেট্টো-গ-২৯-৩২০৪)) দখলে নিয়ে ব্যবহার করছেন ঊর্মি।
এ সব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ঊর্মির ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে গিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। ইন্টারপোল ঢাকা শাখা যদি রিয়াদ দূতাবাসে তথ্য পাঠাত তাহলে দূতাবাস বিষয়টি অবগত হতে পারত। ঢাকা থেকে মেসেজ সৌদি আরবের পুলিশকে পাঠালে তো আমার জানার কথা না। তবে পুরো বিষয়টি জানার পর ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনে দূতাবাসের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা করা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে