কথাশিল্পীর অনন্তলোকে যাওয়ার ১ বছর
১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৪:০৯
রাজশাহী: অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছোটগল্পের এক মহারথি। সবাই যখন ঢাকামুখী, তখন সাহিত্য অঙ্গনে তুমুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও তার আবাস ছিল প্রিয় শহর রাজশাহীতে। থাকতেন তার বাড়ি ‘উজান’ এ। তার নিজ নিবাস ‘উজান’ এ গতবছর (১৫ নভেম্বর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মৃত্যুকালে হাসান আজিজুল হকের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত থাকার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত জটিলতাগুলোও পিছু ছাড়ছিল না তার। গত বছরের জুলাই মাসে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে তাকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে গত ২১ আগস্ট তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। প্রথমে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা শেষে ৯ সেপ্টেম্বর তাকে ফের রাজশাহীতে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে কয়েক মাস শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি।
হাসান আজিজুল হক খুবই আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। প্রায়ই ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বসে যেতেন আড্ডায়। বাইরে কোথাও নয়, ‘উজান’ এ বসত সেই আড্ডা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা-বিহাসের ভেতরে ঢুকে বাঁ দিকের গলিটার শেষ বাড়ি। বিহাসের উজানের আড্ডাটা থাকত প্রাণবন্ত। কিন্তু এখন বাড়িটি একেবারে সুনশান ও নিরবতা থাকে। করোনার প্রভাব পড়েছিল এই বাড়িটাতেও। শেষ দিকে অনেকটা নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে কড়াকড়ি শুরু করেছিল পরিবার।
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখা নিজ গ্রামেই। মাধ্যমিক তথা তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে। এরপরই চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন।
ওই কলেজেই স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নের সময়ই যুক্ত হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। সে কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলেও পড়তে হয়। মেধাবৃত্তি দেওয়া হয়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত ওই কলেজই ছাড়তে হয়। পরে এসে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬০ সালে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া গেলেও বিদেশের পরিবেশ-সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। পিএইচডি শেষ না করেই ফিরে আসেন দেশে।
স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৬০ সালে রাজশাহী সিটি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হাসান আজিজুল হকের। এরপর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি ব্রজলাল কলেজে শিক্ষকতা করেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৭৩ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। সেখানে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন তিনি। এরপর থেকেই রাজশাহী মহানগরীর চৌদ্দপাই এলাকার ‘বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটিতে (বিহাস)’ নিজ বাসা ‘উজান’ এ অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন।
কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক। ১৯৭০ সালেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৯ সালে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পুরস্কার।
এর বাইরেও হাসান আজিজুল হকের পাওয়া পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে— আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার (১৯৯৪), দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশিচমবঙ্গ) (১৯৯৭), ক্রান্তি পদক (২০০৪), হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬), শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮)।
এ ছাড়া ২০১২ সালে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান তিনি। ২০১৮ সালে আইএফআইসি ব্যাংক ‘সাহিত্যরত্ন’ সম্মাননা চালু করলে প্রথমবারই তাকে এই সম্মানায় ভূষিত করা হয়।
সারাবাংলা/ইআ