সুপেয় পানির সংকট নিরসন, নারীদের হাতে মিলল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৬ নভেম্বর ২০২২ ১০:৪৬
রাঙ্গামাটি: জুরাছড়ি উপজেলা হ্রদবেষ্ঠিত হলেও আমাদের সুপেয় পানির সংকট তীব্র ছিল। রান্নাবান্না ও নিরাপদ পানির উৎস ছিল কেবল ঝিরি। এখন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প দিয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা হয়েছে। এর জন্য গ্রামের মানুষ অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। দীর্ঘদিন পর এখানকার মানুষের নিরাপদ পানির দুর্ভোগ কেটেছে- এমন করেই নিজের আত্মতৃপ্তির কথা জানালেন উপজেলার বনযোগীছড়া ইউনিয়নের বাদলপাড়ার বাসিন্দা জোনা চাকমা। ওই এলাকার বিষু রাণী চাকমাও জানালেন একই কথা। জোনার সঙ্গে যোগ করে বিষু রাণী জানান, এক পানির কষ্টই তাদের জীবনকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করেছিল। তবে এখন কিছুটা লাঘব হয়েছে।
গ্রামের মানুষের পানি সংকটের কথা তুলে ধরে ২ নম্বর বনযোগীছড়া ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য নোনাবি চাকমা বলেন, ‘বিগত দুই দশক ধরে এখানকার মানুষ পানীয় জলের সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। ছড়ার কুয়া থেকে এক কলসি পানি আনতে কয়েকঘণ্টা সময় লেগে যায়। সারাদিনের একটা বড় সময় পানি সংগ্রহের কাজে ব্যয় হতো। এখন নিরাপদ পানির পাওয়ার সহজলভ্যতায় স্থানীয় নারীদের দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে। এখন পরিবারিককাজে নারীরা আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবেন।’
রাঙ্গামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা জুরাছড়ি। জেলা শহর থেকে যাতায়াতের একমাত্র পথও নৌ-পথ। এই উপজেলার চারটি ইউনিয়নেই নিরাপদ পানীয় জলের সংকট রয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয় ও ক্রমবর্ধমান খরার কারণে বিগত দুই দশকে এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। সুপেয় পানির পাশাপাশি ও ব্যবহার্য নিরাপদ পানির একমাত্র ভরসা কেবল ঝিরি বা ছড়া। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ঝিরির পানি ব্যবহারের ফলে প্রায়শই গ্রামের শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে বিভিন্নসময়ে পানিবাহিত রোগের দেখা দিত। তবে এখন বনযোগীছড়া ইউনিয়নের কিছু এলাকার নিরাপদ পানির সংকট কমেছে। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে এলাকার মানুষের নিরাপদ সুপেয় পানির সংকটের নিরসন হলো।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বনযোগীছড়া ইউনিয়নের ধুলকুল ও পাঁচপতিমা ছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির আওতাধীন বাদল পাড়া, লহ্মীচন্দ্র মেম্বার পাড়া, এমকে পাড়া, চৌমুহনী পাড়া ও চেয়ারম্যান পাড়ায় ১৭৩টি পরিবারে ৭৭৫ জন বসবাস করে আসছেন। এখানকার অধিবাসীদের সুপেয় ও ব্যবহার্য নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে ২০১৮ সালের শেষদিকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ডানিডা’র যৌথ বাস্তবায়িত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পের’ অধীনে ১২ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটিতে সরকারিভাবে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হলেও ২ লাখ ৭ হাজার টাকা দিতে হয়েছে পাড়াবাসীদের। এই প্রকল্পে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে জমা রাখা হয় বড় ট্যাংকে। আবার সেই ট্যাংক থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ট্যাপকল দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা।
‘ধুলকুল ও পাঁচপতিমা ছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির (সিআরসি)’ মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে সিআরসি কমিটির ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জনই নারী। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে স্থানীয় নারীদের অংশগ্রহণ অগ্রাধিকার পেয়েছে। এজন্য চলতি বছরে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশসহ চারটি দেশ স্থানীয় অভিযোজন চ্যাম্পিয়ানস্ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে সেখানে এই প্রকল্পটি ‘স্থানীয় নারীদের কমিউনিটিতে নেতৃত্বাধীন উদ্যোগের’ জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে ১৫ হাজার ইউরো তহবিল পাবে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে ধুলকুল ও পাঁচপতিমাছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির (সিআরসি) সভাপতি সন্তোষ বিকাশ চাকমা জানান, পাহাড়ে দিনদিন পানির উৎস কমে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান খরা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ঝিরি-ঝরনাগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এখানকার মানুষেরা দীর্ঘ সময় করে ধরে বসবাস করে আসছেন। এতদিন ঝিরি থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। যেসব পানি নিরাপদ না হওয়ার ফলে বিভিন্ন সময়ে পানিবাহিত রোগের দেখা দিতো। এখন সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা হয়েছে। রিজার্জার পানির ট্যাংক থেকে পানি সংগ্রহ করার মাধ্যমে বনযোগীছড়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের মানুষ সুবিধাভোগী হয়েছেন। অন্যদিকে গ্রামের নারীরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটা আমাদের জন্য আরও বেশি আনন্দের।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা পলাশ খীসা জানান, জলবায়ুর বিপন্নতা নিরুপণে সীমিত বাজেটের মধ্য হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ সুপেয় পানির সংকট নিরসনের জন্য কাজ করা হয়েছে। বনযোগীছড়া ইউনিয়নের স্থানীয় পাঁচটি পাড়ার মানুষ এই উদ্যোগের সুবিধাভোগী হয়েছেন। আগে যেখানে কষ্টসাধ্য করে ঝিরি পানির ব্যবহার করতে হতো, এখন তারা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারছেন।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী জানান, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকটের ভয়াবহতা প্রকট আকারে ধারণ করেছে। জলবায়ুর সঙ্গে ভারসাম্যতা বজায় রেখে রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ উন্নয়ন সংস্থার ডানিডা’র সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করছে। প্রকল্পটির অধীনে জুরাছড়ির বনযোগীছড়ায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পানির পাম্প ব্যবহার করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে স্থানীয়দের পানির সংকট সমাধান করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে ডানিডা’র সঙ্গে আমাদের এই যৌথ প্রকল্পটি এবারে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে গত ১২ নভেম্বর স্থানীয় কমিউনিটিতে নারীর নেতৃত্বাধীন অংশগ্রহণের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে।
সারাবাংলা/এনএস