Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দিঘি খননের চেয়ে আনুষঙ্গিক খাতে অধিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৬ নভেম্বর ২০২২ ১১:৩৭

ঢাকা: দেশের উপকূলীয় এলাকায় দিঘি খননের চেয়ে আনুষাঙ্গিক খাতে অধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। একইসঙ্গে খনন কাজের ব্যয়ও বেশি ধরা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দিঘী খনন’ প্রকল্পে এমন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় এসব ব্যয় প্রস্তাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ২১টি (৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৭ ঘনমিটার) দিঘি খনন বাবদ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার খননের খরচ পড়বে ৬৯৮ টাকা। এই ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা ও ভিত্তি সম্পর্কে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পিইসি সভায় ব্যাখা চাওয়া হবে। প্রকল্প প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার মাটি খনন বাবদ ম্যানুয়াল লেবার দিয়ে খননে ২৩৮ থেকে ২৫০ টাকা ও ম্যাকানিক্যাল এস্কাভেটর দিয়ে খনন করলে ১২৬ টাকাসহ ৩০ মিটারের ৩টি লিফট বাবদ আরও ১২০ টাকাসহ ২৪৬ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক ব্যয় যেমন কাঠের বলি, রিইনফোর্সমেন্ট বা সিমেন্ট কনক্রিটের কাজ, সোলার পাম্পিং সিস্টেমসহ ওভারহেড পানি ট্যাংক, ফুটিং বা গ্রেড বিম ভাটিক্যাল ওয়াল, পিলার ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি ধরে ঘনমিটার প্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৯৮ টাকা। এক্ষেত্রে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মনে করছে কমিশন।

এতে দেখা যায়, পুকুর খননে যে ব্যয় হবে তার তুলনায় প্রায় ৪ গুণ আনুষঙ্গিক ব্যয় ধরা হয়েছে। ফলে ব্যয় কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে সভায় মত দেওয়া হতে পারে। একইসঙ্গে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৩টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে পুকুর খননের জন্য দর ৯৯ টাকা, ১৪০ টাকা এবং (ডাবল লিফটিংসহ) ১৮০ টাকা ধরা হয়েছিল। সেই তুলনায়ও প্রস্তাবিত ব্যয় বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পটির অর্থের সংস্থান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এক্ষেত্রে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১০২টি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী মোট অর্থের চাহিদা ২২ হাজার এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামো) অনুযায়ী পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকুলে প্রাপ্ত মোট সিলিং ৭ হাজার ৯৩৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ফলে চলতি বছরে মোট গ্যাপ আছে ১৪ হাজার ৬৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এছাড়া আগামী ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ডিপিপি অনুযায়ী মোট চাহিদা ১৯ হাজার ৮১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং ১৪ হাজার ২৯৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু ওই দুই অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের সিলিং ৮ হাজার ৭৩১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং ৯ হাজার ৬০৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে গ্যাপ হবে যথাক্রমে ১১ হাজার ৮৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ও ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ অবস্থায় গ্যাপ পূরণ করে প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিভাবে অর্থায়ন নিশ্চিত করা হবে— এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখা চাওয়া হবে।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে আরও বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। কিন্তু ডিপিপির বিভিন্ন অঙ্গের যোগফল মোট ৪৬ কোটি ৮৮ লাখ ১১ হাজার টাকা হয়, যা প্রস্তাবিত ব্যয় অপেক্ষা ৭৫ লাখ টাকা বেশি। এ বিষয়ে পিইসি সভায় প্রশ্ন তোলা হবে।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব দীর্ঘকালের। এছাড়াও ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুল এবং ২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আম্ফানে উপকূলীয় সুপেয় পানির উৎসগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি মহাসংকটে রূপ নেয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, নদী প্রবাহে বাঁধা, নদী-খাল দখলসহ নানাবিধ কারণে যুগ যুগ ধরে সুপেয় পানির সংকট অব্যাহত রয়েছে। তাই পুকুর ও দিঘি খনন করে ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ করা আবশ্যক। সরকারি ও খাস জমিতে পুকুর বা দিঘি খনন করা যেতে পারে, যেগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যাবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট মেটানো সম্ভব।

ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় পানির বিশালতা থাকলেও মিঠা পানির উৎস এবং প্রাপ্যতার ভিত্তিতে সংকট সব সময়ই ছিল। আর খুলনা জেলার দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, তালা ও আশাশুনি উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলাগুলো সুন্দরবন এবং সমুদ্র সংলগ্ন হওয়ায় মিঠা পানির সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। অধিকাংশ স্থানেই ভূ-গর্ভে খাওয়ার যোগ্য পানির স্তর না পাওয়ায় গভীর নলকূপ চালু করা যায় না। অগভীর নলকূপের পানিতে রয়েছে মাত্রতিরিক্ত লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণ। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণের জন্য পুকুর ও রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট হচ্ছে ভরসা। বৃষ্টির পানি ধারণ করে তা এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। আবার অপরিকল্পিত চিংড়ির চাষ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে স্থানীয় পুকুরগুলোর অধিকাংশই মিঠা পানির আধার হিসাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই এলাকার অর্ধেক জনগোষ্ঠী বৃষ্টির পানি ও পুকুরের পানি ফিল্টার করে পান করে। বাকি অর্ধেক পুকুরের পান করে ফিল্টার ছাড়াই। ফলে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট চলছেই। দিঘি ঘনন করে বৃষ্টির পানি সংক্ষণ করে এই অঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট মেটানো সম্ভব। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাপাউবো, আইডব্লিউএম এবং সিইজিআইএস গত বছরে গঠিত কারিগরি কমিটির সুপারিশে এ প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।

ডিপিপি অনুসারে প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে, প্রকল্পের আওতায় ২১টি দিঘি খনন বাবদ মোট ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭টি দিঘির জন্য ১২ কোটি এক লাখ ১৯ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। ১৩টি দিঘির জন্য ১৯ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার টাকা এবং একটি দিঘির জন্য ১৩ কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।

প্রকল্পের রাজস্ব খাতে সম্মনি, গাড়ি ভাড়া, সেমিনার ও কনফারেন্স, জরিপসহ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য মোট ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মূলধন খাতের বিভিন্ন অঙ্গের জন্য ৯ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি পরিশোধনের জন্য ৪টি দিঘিতে ২টি করে এবং ১৭টি দিঘিতে একটি করে সর্বমোট ২৫টি পন্ড স্যান্ড ফিল্টার স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দিঘির সুপেয় পানি সংগ্রহ, সুষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪টি দিঘিতে ২টি করে এবং ১৭টি দিঘিতে একটি করে সর্বমোট ২৫টি ঘাটলা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনোভাবেই উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অতিরিক্ত ব্যয় করার সুযোগ নেই। আমাদের সদস্য (সচিব) সহ কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই কেবল ব্যয় অনুমোদনের সুপারিশ দেবেন।’

সারাবাংলা/জেজে/এনএস

দিঘি খনন পরিকল্পনা কমিশন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর