Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাইরেটেড বইয়ে বাজার সয়লাব, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৩ নভেম্বর ২০২২ ২২:৩৩

ছবি সংগৃহিত

ঢাকা: দেশে সরকার পরিবর্তন হলেই শিক্ষা কারিক্যুলামে পরিবর্তন এসেছে। ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে। ফাঁক ফোকর বন্ধে তৈরি করা হয়েছে আইন। বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও বন্ধ নেই পাইরেটেড বই। বরং ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া এসব পাইরেটেড বই বাজারে একচ্ছত্র ব্যবসা করে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব পাইরেটেড বই কতটুকু কাজে লাগছে তা নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। সারাবাংলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে পাইরেটেড বইয়ের পেছনের গল্প।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাজারে মাধ্যমিক পর্যায়ের বই পাইরেটেড হচ্ছে ৮০-র দশক থেকেই। তবে ২০০০ সালের দিকে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ধীরে ধীরে তা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়েও নিয়ে যায়। গত দুই যুগের ব্যবধানে মাধ্যমিক শিক্ষায় পাইরেটেড বই কমে এলেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে তা জেঁকে বসেছে। পাইরেটেড বইয়ের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কোনো কাজে আসেনি। বরং আইনকে তোয়াক্কা না করেই পাইরেটেড বইয়ে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বাংলাবাজার ও নীলক্ষেতসহ কয়েকটি এলাকায় কয়েক শত কোটি টাকার পাইরেটেড বইয়ের বাণিজ্য হয়ে আসছে। আর নীলক্ষেতকেন্দ্রিক তা ছাড়িয়ে হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

বাংলাবাজার পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শ ম গোলাম কবির সারাবাংলাকে বলেন, পাইরেটেড বইয়ের কারণে ভ্যাট ট্যাক্স প্রদানকারী পুস্তক ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে। আমরা ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করলে পাইরেটেড বই তৈরিকারকরা এর কয়েকগুণ বেশি ব্যবসা করছে। বাংলাবাজার, সুত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, ওয়ারী ও তার আশেপাশে তারা অন্তত ৫০০ কোটি টাকার পাইরেটেড বই ছাপিয়ে থাকে। এমনকি আমাদের প্যাটেন্ট বইও ছাপিয়ে সারাদেশে দিয়ে আসছে। অনেক অভিযান করিয়েও কোনো লাভ হয় না। এক কারখানায় অভিযান চললে আরেক কারখানায় বই ছাপা হয়। বিভিন্ন জেলার বুক স্টলের মালিকরা কম দামে যেখানে পাবে সেখান থেকেই বই কিনবে। কারণ ওসব বইয়ে লাভ বেশি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, পাইরেটেড বই ছাপানো বা বিক্রির তথ্য পেলে আমরা সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে জানাই। পুলিশ কখনো অভিযান চালায় আবার কখনো চালায় না। মোটা অংকের টাকা খেয়ে চেপে যায় এমন অভিযোগও আছে আমাদের কাছে। ফলে আমরা আর এগুতে পারি না।

বাংলাবাজার পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিনিয়ত বইয়ের বাজার ছোট হয়ে আসছে পাইরেটেড বইয়ের কারণে। বছরে একটি বই মেলা হয়, সেখানেও পাইরেটেড বইয়ে ছেয়ে যায়। কাজেই মূলধারার যে পুস্তক ব্যবসায়ী আছেন তারা বিপাকে পড়েন।

তিনি আরও বলেন, পাইরেটেড বইয়ের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর আইন করে তা বন্ধ করতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, অন্যদিকে পেটেন্টধারী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সেক্ষেত্রে অনেকে বলতে পারে, শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার বিদেশি বইগুলোর অনুমতি সাপেক্ষে সরকারিভাবে অথবা নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর দায়িত্ব দিতে পারে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, অনুমোদিত বিদেশি কোম্পানিগুলো রয়্যালিটি পাবে; আবার প্রতিষ্ঠানগুলোও রক্ষা পাবে।

নীলক্ষেতে শাহজালাল মার্কেট বহুমুখী সমিতির সভাপতি এম আবু জাফর বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে বইয়ের ব্যবসা করছি। এখন আর চলছে না। কেউ কেউ বিদেশি বই ফটোকপি করছেন, তা বাইন্ডিং করে কম দামে বিক্রি করছেন। ফলে আমরা মানসম্মত বই ছাপিয়ে টিকে থাকতে পারছি না। বইয়ের ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন অনেকেই। অনেকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন।

নীলক্ষেত বই মার্কেটের ইসলামিয়া লাইব্রেরির স্বত্বাধাধিকারী মিজানুর রহমান বলেন, ইন্ডিয়াতে আছে টাটা-ম্যাকগ্রা হিল। তারা বিদেশি বই এর স্বল্পদামী সংস্করণ ছাড়ে। বাংলাদেশেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে বিদেশি বই ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

পাইরেটেড বইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা নাহিন সারাবাংলাকে বলেন, বই বা জ্ঞান চুরি অপরাধ নয়। আর এ অবস্থায় নীলক্ষেতে পাইরেটেড বই না থাকলে আমার বা আমার মত অনেকের লেখাপড়া সম্ভব হত না।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বিল্লাল হোসেন বলেন, বিদেশি বই দেশে ছাপালে অসুবিধা তো দেখি না। দেশে ছাপালেও তো সরকার ভ্যাট পেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম সাদিক বলেন, বিদেশি বই ছাপানোর ব্যাপারটা এত সহজ নয়। বিদেশি পাবলিশার্সরা সাধারণত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য আলাদা লো প্রাইস এডিশন বই ছাপিয়ে থাকে। আলাদাভাবে বাংলাদেশে ছাপানোর অনুমোদন তারা দেবে বলে মনে হয় না। ছাপানোর অনুমোদন পেলে ভালোই হতো। এতে ছাত্রদের অনেক বেশি উপকার হতো।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরেফিন ফয়সাল নবীন বলেন, মেডিকেল লাইনে পাইরেটেড বই না থাকলে এদেশে ডাক্তারি পড়া সহজ হতো না। কেননা কোনো কোনো বইয়ের দাম ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকাও রয়েছে। আর ৫ থেকে ১০ টাকার বইতো অহরহ আছে। পাইরেটেড বই হওয়ায় একেকটি বই দুই থেকে তিন হাজার টাকায় কিনে ডাক্তারি পড়া সম্ভব হচ্ছে। যখন ইন্টারনেট বা এসব পাইরেটেড বই ছিল না তখন ডাক্তারি পড়া অনেক কষ্টকর ছিল। একেকটা টপিক্স নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করলেও কিছুই বোঝা যেত না বলে স্যারেরা সবসময়ই বলেন।

পাইরেটেড বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) এ কে এম হাফিজ আকতার বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অভিযান চালিয়ে থাকি। কে কখন কোথায় পাইরেটেড বই ছাপাচ্ছে তার তথ্য পুস্তক ব্যবসায়ীদেরই জানাতে হবে। থানা পুলিশকে অবহিত করা আছে। তারা ব্যবস্থা নেবে। প্রচলিত আইনে পাইরেসিকারকদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/রমু/পিটিএম

নীলক্ষেত পাইরেসি বই বাংলাবাজার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর