তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: ১০ বছরেও শেষ হয়নি বিচার, ঝুলছে সাক্ষ্যতে
২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৮:৪১
ঢাকা: রাজধানীর অদূরে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আজ ১০ বছর। সেই অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১১৩ জন শ্রমিক। ভয়াবহ ওই ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম মামলাটি দায়ের করলেও ১০ বছরেও শেষ হয়নি তার বিচার কাজ। এখনও শেষ হয়নি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষীরা আদালতে ঠিকমত না আসার কারণে মামলার কার্যক্রম শেষ হতে বিলম্বিত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলারা আলো চন্দনার আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। তবে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি। এজন্য আদালত আগামী ১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিধ ধার্য করেন। এখন পর্যন্ত মামলাটিতে ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ. কে এম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আমরা প্রসিকিউশন পক্ষ ও আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। প্রতি ধার্য তারিখে সাক্ষীদের মোবাইল ফোন এবং সমনের মাধ্যমে জানানো হয়। কিন্তু সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ার কারণে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। সাক্ষীরা মুখে বলে বিচার চাই কিন্তু তারা আন্তরিক ভাবে বিচারের জন্য সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন না।’
সাক্ষীরা আন্তরিক না উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, ‘আন্তরিক হলে তারা সংঘবদ্ধভাবে আদালতে আসতেন। প্রসিকিউশন সর্বত্রই সাক্ষীদের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও যারা আদালতে এসে সাক্ষী দিয়ে যান তাদের কেউ বলা হয় অন্যদের নিয়ে আসো। আমরা প্রসিকিউশের পক্ষ থেকে নিঃস্বার্থভাবে বিচার প্রার্থীদের সহযোগিতা করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে ঠিক কত বছর সেটা বলা কঠিন। মামলার প্রসিডিউর অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে। মামলার সাক্ষী দ্রুত এলে ইচ্ছা করলে দুই মাসের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা যায়। সাক্ষ্যগ্রহণে যত বিলম্ব হবে, মামলা শেষ করতে তত দেরি হবে। সাক্ষী যত দ্রুত হবে মামলা নিষ্পত্তি তত দ্রত হবে। একাধিকবার সমন দেওয়ার পরেও যারা সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন না তাদের বিরুদ্ধে নন বেইলএবল পরোয়ানা জারি করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় দশ জনের অধিক সাক্ষীকে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এরপরও তারা ঠিকঠাক আসেন না। আশা করি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে পারবো।’
অন্যদিকে আসামি দেলোয়ার ও মাহমুদার আইনজীবী হেলেনা পারভীন বলেন, ‘মামলার সাক্ষী না আসার কারণে বিচার শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। এক তারিখে সাক্ষী আসে তো অন্য তারিখে আসে না। সাক্ষীরা অধিকাংশ সব গার্মেন্টস কর্মী। এজন্য ঠিকমত সাক্ষীদের খোঁজে পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আবারও অনেকেই আগের জায়গায় ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছেন। তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ডের মামলায় মোট ১০৪ জন সাক্ষী রয়েছে। এদের মধ্যে ১১ থেকে ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হতে পারে। কিন্তু বাকি সাক্ষীদের বার বার সমন দেওয়ার পরেও তারা আদালতে হাজির হচ্ছেন না। এতে আরও বিলম্বিত হচ্ছে মামলাটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। কোন কোন আসামি ঠিকমত আইনজীবীদের ফি পর্যন্ত দিতে পারছেন না। আসামিরাও বিচারপ্রার্থী। এই মামলার জন্য তাদের প্রতি মাসেই আদালতে আসতে হয়। এর ফলে পারিবারিক, মানসিক, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। আমরাও ন্যায় বিচার চাই। আশা করি, সাক্ষ্য, প্রমাণ শেষে আসামিরা এই মামলা থেকে খালাস পাবেন।’
২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের পর ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির পুলিশের পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামান।
মামলার অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল।
তবে এই মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে আল আমিন, রানা, শামীম, ও মোবারক হোসেন পলাতক রয়েছে। বাকি সব আসামি জামিনে রয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তাজরীন গার্মেন্টস ভবনের নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া বলে শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়।
২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১৩ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়। অন্যদিকে আহত হন আরও ১০৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। গার্মেন্টসটিতে সে সময় ১ হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন, পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। ৫৮ জনের লাশ শনাক্ত হওয়ায় তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৫৩ জনের লাশ শনাক্ত না করতে পারায় তাদের জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সারাবাংলা/এআই/এমও