Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংকটেও থেমে নেই ডিজিটাল প্রচারে ডলার খরচ!

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৪ নভেম্বর ২০২২ ২১:৫০

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। তাই অন্যান্য দেশের মতো কৃচ্ছ্রতা সাধনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশও। কিন্তু এই সংকটেও ডিজিটাল প্রচারে ডলার খরচ থেমে নেই। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা প্রকল্পে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলে প্রচারে আলাদা করে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতায় ফেসবুক পেইজ তৈরি, সুর্নিদিষ্ট লাইক অর্জন, নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরি, পোস্ট-প্রমোশনে অর্থ খরচ করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ডিজিটাল মিডিয়া বায়িংয়ের জন্য দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিপিপির শর্তও মানা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে এসব ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারেও ডলার খরচ থেমে নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দলই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট বুস্ট করছে।

বিজ্ঞাপন

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ এ ফেসুবক মিডিয়া বায়িং এ ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি ফ্যান পেইজে আড়াই লাখ করে লাইক অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫ হাজার পোস্ট প্রমোশনে ৪০ লাখ টাকা, ক্লিক টু ওয়েবসাইটে (সিঙ্গেল ক্রিয়েটিভ) ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া ওয়েবসাইটে ক্লিক করার আরও দুই ধরনের অ্যাড রয়েছে। ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিংয়ে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভিডিও প্রমোশনে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। গুগল মিডিয়া বায়িংয়ে (ডিসপ্লে ডেস্কটপ অ্যান্ড মোবাইল, ভিডিও ইউটিউ, ইউনিভার্সেল অ্যাপ ইন অ্যাপ মার্কেটিং ও সার্চ) ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিপিপিতে পাঁচটি ফ্যান পেইজের কথা বলা হলেও দরপত্রের টার্মস অব রেফারেন্সে (টিওআর) একটি ফেসবুক পেইজের কথা বলা হয়েছে। সেখানে নিয়ম ভেঙে এক পেইজেই ২৫ লাখ লাইক অর্জনের শর্ত দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে এই প্রকল্পের পরিচালক আবদুল্লা-আল-শাহীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পটি একবার সংশোধন হয়েছে। আর আরডিপিপি ও টর (টার্মস অব রেফারেন্স) অনুযায়ী কাজ করছি। একটি প্রকল্পের জন্য তো একাধিক পেইজ থাকতে পারে না।’

এদিকে, ফেসবুক পেইজে ফেইক লাইক দেখিয়ে অর্থ নেওয়া হচ্ছে কিনা? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেসবুক পেইজের পুরো নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে। যারা কাজ পেয়েছে তাদের শুধু এডমিন করে রাখা হয়েছে। তারা কত ডলার পেমেন্ট করছে, আমরা তা দেখতে পারছি। তাই ফেক লাইক দেখিয়ে ডলার কেটে নেওয়া সম্ভব নয়।
সরকার কৃচ্ছ্রতাসাধন করলেও বিজ্ঞাপনে ডলার খরচ কেন করা হচ্ছে? এর উত্তরে প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লা-আল-শাহীন বলেন, ‘পুরো প্রকল্পটিই প্রচারণামূলক। কৃচ্ছ্রতা সাধনের জন্য সরকার ২৫ শতাংশ খরচ সাশ্রয় করার নির্দেশ দিয়েছে।’ তবে প্রচারণার জন্য ডলার খরচ করতে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। তবে এসব বিষয়ে জানতে ধর্ম সচিবকে একাধিবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এদিকে, ‘নির্বাচনি ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পে ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলসহ ডিজিটাল মাধ্যমে ইভিএম সম্পর্কিত ডিজিটাল প্রচারণায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথি থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত সকল ডিজিটাল মিডিয়া বিজ্ঞাপন ও ব্যবস্থাপনা (টিভিসি, ইনফো গ্রাফিক্স, ব্যানার বিজ্ঞাপন, প্রি-রোল বিজ্ঞাপন, পপ আপ ভিডিও, ইভিএম এর ইতিবাচক কন্টেন্ট, বছরব্যাপী ইভিএম এর নেতিবাচক কন্টেন্টগুলোর বিরুদ্ধে ইতিবাচক প্রচারণা) ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, শেয়ার ইট, গুগল ডিসপ্লে নেটওয়ার্কে এসব কনটেন্ট প্রচার করা হবে। ইভিএম’র আস্থা অর্জন সম্পর্কিত জনমত জরিপ, জনপ্রিয় ও সর্বজনগৃহীত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে নেতিবাচক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগল ডিসপ্লে নেটওয়ার্কে প্রচারণায় ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, টিকটক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, শেয়ার ইট, গুগল ডিসপ্লে নেটওয়ার্কে ইভিএম’র আপগ্রেডেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কন্টেন্ট প্রচারে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলসহ ডিজিটাল মাধ্যমে ইভিএম সম্পর্কিত ডিজিটাল প্রচারণায় ৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে, সরকারি প্রকল্পে প্রমোশন বা বোস্টের ক্ষেত্রে ফেক লাইক দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেসরকরি ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকে। এমন লাইক ফার্মিং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপ ফেসবুকেও চোখে পড়ে। ফেক লাইক প্রসঙ্গে অ্যানালাইেজন বাংলাদেশ লিমিটেডের দ্য ম্যান অব স্টিল (চেয়ারম্যান) রিসালাত সিদ্দীক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফেসবুকে বট দিয়ে আর্টিফিশিয়াল লাইক বাড়ানো হচ্ছে ফেক লাইক। সাধারণ মানুষ যখন কোনো পেইজ বা পোস্টে লাইক দেয়, সেই ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেক কাজ করে। কিন্তু ফেক লাইকে ব্যবহৃত আইডিগুলো অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয় না। ফেসবুক এখন বুঝতে পারে কোন লাইকটি হিউম্যানের, আর কোনটি হিউম্যানের নয়। ফেসবুক এখন তার অ্যালগারিদম চেক করেই বুঝতে পারে কোনটি ফেক লাইক। ফেসবুকে যেমন ফেক লাইক করা যায়, তেমনি ফেসবুক সেই লাইক রিমুভও করে দেয়। এটি এক প্রকারের যুদ্ধ।’

তিনি বলেন, ‘চীনে লাইক ফার্মিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফেসবুকেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ রয়েছে। কিন্তু ফেক লাইক এখন আর আগের মতো করা যায় না। পেইজ থেকে দেখবেন হঠাৎ করে লাইক কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল লাইক ফেসবুক রিমুভ করে দেয়। যারা ফেসবুকে ফেক লাইকের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ফেসবুকও এখন সেটা বুঝতে পারে।’

অর্থনৈতিক সংকটেও ফেসবুক-ইউটিউবে প্রমোশন কতটা যৌক্তিক? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘আগের চেয়ে ফেসবুকে প্রমোশন কমে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করা হয়েছে। ই-কমার্স কেনাকাটায়ও লেনদেনের লিমিট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে গিকি সোস্যালের এমডি মাহাদী হাসান সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু কিছু মানুষ ফেক লাইক প্রোভাইড করে থাকে। আমরা বলে থাকি টাকা দিয়ে লাইক কিনবেন না। ফেসবুকে কমিউনিটি বিল্ড করবেন। টাকা দিয়ে লাইক কিনলে সেটি সাসটেইনেবল হয় না।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকার যেহেতু কৃচ্ছ্রতাসাধন করছে, ডলার সেফ করার চেষ্টা করছে, ঠিক একই সময়ে সরকারিভাবেই ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের পোস্ট বোস্ট করা হলে সেটি হবে সাংঘর্ষিক।’

এ প্রসঙ্গে আজকের ডিল এর সিইও ফাহিম মাশরুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বড় বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে ফোকাস করে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ করছে দেশের বাইরে থেকে। ফলে সরকার কর বঞ্চিত হচ্ছে। এটি আইগতভাবে এক ধরনের হুন্ডি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রমোশনের জন্য সরকার কেন খরচ করবে? প্রমোশন করার জন্য বিটিভি আছে। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট আছে। পয়সা খরচ করে অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো যুক্তি দেখি না। শুধু এই ডলার সংকটের সময়ই নয়, অন্য যেকোনো সময়ই মন্ত্রীর কথা ফেসবুকে বুস্ট করাকে আমি অনৈতিক মনে করি।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এখন আমাদের ডলার সাশ্রয় করতে হবে। সেজন্য ফেসবুক, ইউটিউবে প্রচার-প্রচারণা না চালিয়ে দেশের প্রচলিত অনলাইন মিডিয়াকে প্রধান্য দেওয়া উচিত। এতে করে ডলার সাশ্রয় হলো, আবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একই ধরনের প্রচারও ব্যাহত হলো না। ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বা ডিজিটাল প্রচারণা এখন খুবই কার্যকর। তাই সেটি সংকটের মধ্যেও বন্ধ করা উচিৎ হবে না। তবে তা করতে হবে দেশীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে।’

তবে বেসিসের বর্তমান সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘সরকারি কোনো প্রোগ্রাম বুস্ট করা উচিৎ নয়- এই বিষয়টির সঙ্গে আমি একমত নই। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো প্রোগ্রাম বুস্টে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।’

ডিজিটাল প্রচার নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভাবনা জানতে চাইলে মন্ত্রী এম এ মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের প্রচার বা বিজ্ঞাপনের বিষয়টি তথ্য মন্ত্রণালয় দেখে থাকে। আমার জানা মতে, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জন্য এখনও নীতিমালা নেই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সরকার সংকটে নেই। বরং বলতে পারেন অর্থনৈতিক চাপে আছে। চাপে থাকলে ওষুধ কেনা বন্ধ থাকবে এমন তো নয়। তেমনি প্রচারও চালাতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রমোশনাল কার্যক্রম আমরা নিরুৎসাহিত করছি, যাতে দেশের অর্থ বাইরে না যায়। আমরা ফেসবুক-ইউটিউবে পোস্ট প্রমোশন বা বুস্ট নিরুৎসাহিত করছি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয় কৃচ্ছ্রতাসাধন করছি। ইতোমধ্যে ১৭টি প্রোগ্রাম আমরা বাতিল করেছি। অন্যান্য মন্ত্রণালয় যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রমোশনাল কার্যক্রমে ডলার খরচ না করে সে বিষয়েও আমরা পরামর্শ দিচ্ছি।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

ডলার খরচ ডিজিটাল প্রচার

বিজ্ঞাপন

সিইসিসহ নতুন ৪ কমিশনারের শপথ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:১০

আরো

সম্পর্কিত খবর