Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাক লাগানো উন্নয়নের ভিড়ে ‘উপেক্ষিত’ কেবল কালুরঘাট সেতু

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:২২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৪ বছরের মেয়াদে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলসহ তাক লাগানো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ‘ইকোনমিক হাব’ হিসেবে বন্দরনগরীকে গড়ে তোলার লক্ষ্যের কথা বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এই লক্ষ্য নিয়েই ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ পথচলা শুরু চট্টগ্রামের। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (৪ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে কেন্দ্র করে সরকারের বন্দরনগরীকে দৃশ্যত পাল্টে দেওয়া এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা এখন ‍মুখে মুখে ফিরছে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। যা সাধারণ মানুষকেও উদ্দীপ্ত করছে বলে দাবি আওয়ামী লীগের।

তবে তাক লাগানো সব উন্নয়নকে ছাপিয়ে এর মাঝে ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর কথাও ফিরছে মানুষের মুখে মুখে। একটি সেতুর জন্য লাখো মানুষের প্রতিদিনের দুর্ভোগ, বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি গত ৩২ বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়া- আশার মাঝে এটি হতাশার চিত্র হয়েই ধরা দিচ্ছে। ’৩২ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি’- বলছেন সেতুর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এক সংগঠক।

রোববার চট্টগ্রাম সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় সূত্রে সারাবাংলা জানতে পেরেছে, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার স্থান লালদিঘি মাঠে নির্মিত মঞ্চ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনটি প্রকল্প— ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় হালদা নদী ও ধুরং খালের তীর সংরক্ষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সন্দ্বীপে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় স্লোপ প্রতিরক্ষা কাজের মাধ্যমে পুনর্বাসন প্রকল্প ও বাঁশখালী উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশের স্থায়ী পুনর্বাসন প্রকল্প উদ্বোধন করা হবে।

এছাড়া কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি এবং রাউজানে তিনটি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ উদ্বোধন হবে। নগরীর চন্দনপুরায় দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসার ছয়তলা ভবন, সীতাকুণ্ড টেকনিক্যাল স্কুলে একটি পাঁচতলা ভবন ও একটি চারতলা প্রশাসনিক ভবন, ওয়ার্কশপ, একতলা সার্ভিস এরিয়া এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ ভবন নির্মাণকাজও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

এগুলোর পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে নগরীর চন্দনপুরায় গুল-এ-জার বেগম সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন, কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ১০ তলা অ্যাকাডেমিক ভবন, কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন, পূর্ব বাকলিয়া সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন, মীরসরাই উপজেলার করেরহাট কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ভবন, পাঁচলাইশ থানাধীন বন গবেষণাগার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন, বোয়ালখালী উপজেলায় হাজী মোহাম্মদ জানে আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ভবন, পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ভবন, সন্দ্বীপের সন্তোষপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ভবন ও নগরীতে সরকারি সিটি কলেজে ১০ তলা অ্যাকাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ এবং নগরীর পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও সিএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনের সম্প্রসারণ কাজ উদ্বোধন করা হবে।

উদ্বোধনের তালিকায় আরও আছে- মীরসরাই ও লোহাগড়ায় ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ, বিটাক চট্টগ্রাম কেন্দ্রের নারী হোস্টেলের নির্মাণকাজ, নাসিরাবাদ শিক্ষানবিস প্রশিক্ষণ দফতর সংস্কার ও আধুনিকায়ন কাজ, দেওয়ানহাটে হর্টিকালচার সেন্টারে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও অফিস এবং চট্টগ্রাম বন্দরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি টাগবোট এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্প।

এর বাইরে আরও চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেগুলো হচ্ছে— চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সন্দ্বীপে জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ, আনোয়ারায় মেরিন অ্যাকাডেমির আধুনিকায়ন, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান স্থাপন এবং বিপিসি ভবন নির্মাণ।

চট্টগ্রামকে বদলে দেওয়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড

যেসব প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ‘উন্নয়নের মহাসড়কে পথচলার’ বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ফ্লাইওভার এবং চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প অন্যতম।

প্রকল্প সংশ্লিষট সূত্র ও জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের বৃহত্তম ইকোনোমিক জোন। এই শিল্পনগরে প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যেখানে ১৩৩ জন বিনিয়োগকারীকে প্রায় ৭ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১৫টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন আছে। ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে বাস্তবায়নাধীন এই শিল্পনগর থেকে প্রতিবছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্য রফতানি হবে। ইতোমধ্যে নয়টি শিল্পকারখানার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া উদ্বোধন করা হয়েছে চারটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও তিনটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো।

এছাড়া, ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা উপজেলার গহিরায় ৭৭৪ একর জমি নিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার একটি প্রকল্পও নিয়েছে সরকার। আর ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে উপমহাদেশের প্রথম টানেল, যা চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে গড়ে তুলবে। আগামী বছরের মার্চে এই টানেল উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত উন্নয়নের জন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ বছর মেয়াদী একটি মাস্টারপ্ল্যান কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রণয়ণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে জোয়ারের সময় শুধুমাত্র ৮ থেকে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে এবং বছরে ৩০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হয়। আগামী ১০০ বছরের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বড় বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে জোয়ারের সময় ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে এবং বছরে ৪৫ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বছরে ৪০০ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। ঢাকার পর চট্টগ্রামেও নেয়া হচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্প। চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বিশ্বের মধ্যে দীর্ঘতম। চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার একটি আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকায় ওয়াসার ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২’ প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর পানি পরিশোধন করে দিনে ১৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার সুপেয় পানি সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। কর্ণফুলীর তীরে বোয়ালখালীতে দিনে ৬ কোটি লিটার ধারণক্ষমতার ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষের পথে আছে। নগরীর হালিশহরে ১৬৫ একর জায়গায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প চালু হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের আমলে নির্মিত ৩০০ মেগাওয়াটের আনোয়ারা পাওয়ার প্ল্যান্ট, ১১০ মেগাওয়াটের কর্ণফুলী পাওয়ার প্ল্যান্ট, ১০৫ মেগাওয়াটের শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ৫৪ মেগাওয়াটের পটিয়া পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৫৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় ৫৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘কম্বাইন্ড সাইকেল’ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তীরে। এছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, বন, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ বিভিন্ন খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তথ্য দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

কালুরঘাটে সেতু কি আদৌ হবে ?

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় ১০০ বছরের পুরনো বিদ্যমান কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি যানবাহনও চলে। বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের নগরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সেতু। একমুখী সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এছাড়া লক্করঝক্কর সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ঝুঁকি তো আছেই। যেকোনো সময় মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে, বিশেষজ্ঞদের এমন মতামতের পর গত এক দশক ধরে সেতুর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন স্থানীয়রা।

১৯৯১ সাল থেকে প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কালুরঘাটে রেলওয়ে সেতুর পাশে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু সেসময় পাঁচ বছরে তারা এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি।

২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। প্রতিশ্রুতি ছিল, কালুরঘাটে সেতু নির্মাণ করা হবে। সেতুর দুই পাড় নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসন বোয়ালখালী-চান্দগাঁও থেকে নির্বাচনে জিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান। এলাকার মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে কালুরঘাটের বদলে আরও দক্ষিণে গিয়ে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু যা ‘শাহ আমানত সেতু’ নামেও পরিচিত, সেটি নির্মাণ করে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেতুর দাবি আরও জোরালো হয়। ২০১৪ সালে আন্দোলন শুরু করে ‘বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ’। দফায় দফায় প্রতিশ্রুতি, বিভিন্ন আশ্বাসের পরও সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া ঝুলে থাকে। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের সাবেক সাংসদ মঈনউদ্দিন খান বাদল সংসদে জোরালোভাবে দাবি তোলেন। এমনকি সেতু নির্মাণ না করলে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান।

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ও রেল মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দৌড়ঝাপের পরও এক বছরের মধ্যে কাজ শুরু হয়নি।

এ অবস্থায় গত আগস্টে কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান সেতুর একটি নকশা তৈরি করে, যাতে সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন এই নকশা চূড়ান্ত হলেও ২০২৫ সালের আগে নির্মাণকাজ শুরুর সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কালুরঘাট সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত ফোকাল পারসন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা।

সারাবাংলাকে তিনি জানান, সম্ভাব্য দাতা সংস্থা কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব এক্সিম ব্যাংকের নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন বা দোহা নতুন নকশায় সেতু নির্মাণের প্রাথমিক সমীক্ষা প্রতিবেদন গত ২৯ নভেম্বর জমা দিয়েছে। সেটা যাচাইবাছাই করে ৫ ডিসেম্বর রেলভবনে এ সংক্রান্ত সভায় উপস্থাপন করা হবে। এরপর চূড়ান্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।

ফোকাল পারসন গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আশা করছি আগামী জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাব। ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে প্রকল্পের সারসংক্ষেপ তৈরি করতে জুলাই পর্যন্ত সময় লাগবে। ২০২৩ সালের শেষদিকে একনেকে উঠতে পারে। এরপর টেন্ডারসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে ২০২৫ সালের শুরুতে আমরা কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।’

নতুন নকশায় সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে সিঙ্গেল ডেকে অর্থাৎ চার লেইনের সেতু। এর একপাশে থাকবে ট্রেন আসা-যাওয়ার দু’টি পথ এবং অপর দু’টি পথ থাকবে গাড়ি আসা-যাওয়ার জন্য। যাতে সাত হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেতুর জন্য এক দশক ধরে আন্দোলন করে বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক মো. আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে গত ৩২ বছরে সরকারের পর সরকার দেখলাম, সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে গেল, কেউ কথা রাখল না। এত হাজার হাজার মানুষের নিত্যদিনের দুর্ভোগ, ভোগান্তি, অনেকের প্রাণহানি কিছুই যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চোখে পড়ছে না। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নেয়া হচ্ছে, কিন্তু জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন যাবে কিভাবে?’

‘এখন বলছে ২০২৫ সালে কাজ শুরুর কথা। এর মধ্যে বিশ্বমন্দা শুরু হয়েছে, দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতিও ভালো নয়, আদৌ এই সেতু হবে কি না, আমরা জানি না। টানেল হয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। কিন্তু একটি সেতুর দাবি কেন উপেক্ষিত হচ্ছে- সেটা আমরা জানি না। শুধু বলতে পারি, আমরা হতাশ। আমরা চট্টগ্রামের জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এ ব্যাপারে সুষ্পষ্ট ঘোষণা শুনতে চাই’— বলেন আব্দুল মোমিন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

উন্নয়ন কালুরঘাট চট্টগ্রাম সেতু

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর