জাপার লাগাম রওশনের হাতে, ‘একঘরে’ জিএম কাদের
৫ ডিসেম্বর ২০২২ ২২:৫১
ঢাকা: জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। এক পর্যায়ে তা প্রকাশ্যেও আসে। এভাবেই চলছিল জাপা। কিন্তু হঠাৎ করেই রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকমাস দেশের বাইরে ছিলেন। আর এই সুযোগে দলে একক আধিপত্য বিস্তার করেন জিএম কাদের। কিন্তু রওশন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে জাপার লাগাম টেনে ধরেছেন। এতে ‘একঘরে’ হয়ে গেছেন চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
সূত্র জানিয়েছে, দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় জিএম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি এখন এক প্রকার কোণঠাসা। দুয়েকজন দলীয় এমপি ছাড়া কেউ নেই তার সঙ্গে। দলীয় এমপিদের বেশিরভাগ এখন রওশনের সঙ্গে। প্রতিদিনই তারা দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন এবং তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট যুদ্ধে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পার্টির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, জিএম কাদের এখন পার্টির সব কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছে। তার কার্যক্রমে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে তিনি দলের পদ হারাবার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ সেই অভিযোগের তদন্ত করছে বলে জানান দলের এক নেতা।
এই পরিস্থিতিতে দলটির কোনো শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাচ্ছে না। তারা মনে করছেন, জাপার নেতৃত্ব এখন দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। নেতৃত্ব কার হাতে যায় সেই ভয়ে তারা কথা বলতে চাচ্ছেন না। যদিও বর্তমানে জাপার লাগাম রওশন এরশাদের হাতে। তারপরও হিতে-বিপরীত হলে দলীয় মনোনয়ন হারাতে পারেন অনেকে। সেদিকে খেয়াল রেখে মিডিয়ায় নাম গোপন রাখার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন নেতারা।
এ সব বিষয় নিয়ে দলটির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সামনে জাতীয় নির্বাচন। দলের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা হতাশায় রয়েছন। বলতে গেলে দলীয় সব কার্যক্রম বন্ধ। এ অবস্থা চলতে থাকলে দলটি ফের ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই সবাই মিলে-মিশে ভুলত্রুটি সংশোধন করে ফের জাপাকে শক্তিশালী করতে হবে।’
সংসদের বিরোধীদলীয় এই চিফ হুইপ বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে দলের এমপিরা দেখা করেছেন। দুয়েকজন দেখা করেননি। তারা হয়তো দেশের বাইরে রয়েছেন। যারা দেখা করেছেন তারা রওশন এরশাদের কাছে কী কমিটমেন্ট করেছেন তা আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি, দলের সকল সংসদ সদস্যই বিরাজমান সমস্যা সমাধান করে ঐক্যবদ্ধভাবে জাপাকে শক্তিশালী করার কথাই বলেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে দলীয় নেতাকর্মীরা হতাশাগ্রস্থ। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সামনের জাতীয় নির্বাচন, দল আসলে কোন দিকে যাচ্ছে? দল মূলত দুইটি গঠনতন্ত্রে চলে। এভাবে দল চালানো ঠিক নয়। কোন গঠনতন্ত্র আসল তা আমি বলতে পারি।’
উল্লেখ্য, দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর মৃধা গত ৪ অক্টোবর জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। একই মামলায় দল থেকে মৃধার বহিষ্কারাদেশকে বেআইনি ঘোষণা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০ এর উপধারা ১(১) অবৈধ ঘোষণা চাওয়া হয়।
মৃধার মামলায় আদালত গত ৩১ অক্টোবর জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার একই আদালতে আবেদন করেন জিএম কাদের। কিন্তু তার ওই আবেদন আদালত নাকচ করে দেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে ১ নভেম্বর থেকে কার্যত দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন তিনি।
দলটির একাধিক নেতা জানান, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার মৃত্যুর ছয় মাস আগে ১ জানুয়ারি জিএম কাদের তার বড় ভাই এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে ‘জাতীয় পার্টির জন্য ভবিষ্যৎ নির্দেশনা’ শিরোনামে একটি চিঠিতে সই করান। এরপর জিএম কাদের প্রথমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, পরে চেয়ারম্যান হন। যা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।
এর আগে, ২০১৯ সালের ২২ মার্চ জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেন এরশাদ। ৪ মে ফের তাকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। ওই সময় এরশাদ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তিনি স্বাভাবিক বিবেচনা প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন না। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন জি এম কাদের। দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে চেয়ারম্যান ঘোষণার কোনো বিধান নেই।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম