মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’, অরক্ষিত বাস্তুভিটা
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৩:১৯ | আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৩:২০
রংপুর: অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভিটা। এমনকি তার জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণায় চালু থাকা স্মৃতিকেন্দ্রটিও পড়েছে মুখ থুবড়ে। কোলকাতা থেকে পায়রাবন্দে দেহাবশেষ আনার উদ্যোগও চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। এদিকে রোকেয়াকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ অনুরাগীদের। তার জন্ম এবং মৃত্যু একইদিনে। ঘটনাটি বিরল হলেও বছরে একটি দিনই তাকে স্মরণ করার শুধু সুযোগ হয়।
উনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী, সেই সময় নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বেগম রোকেয়া। এই উপমহাদেশে নারীর যে অগ্রগতি তা অর্জনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্ম প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। স্মৃতি ধরে রাখতে তার জীবন, দর্শন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্মৃতি কেন্দ্র ২০০১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এরপর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতি কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমিকে দেখভালের দায়িত্ব দিলেও স্থবির হয়ে আছে স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম। তিনজন কর্মকর্তা এবং ছয়জন কর্মচারী থাকলেও দেখা মেলেনা অধিকাংশদের।
সরেজমিনে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, লাইব্রেরিতে সামান্য কিছু বই থাকলেও বাড়েনি সংগ্রহ। রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র। অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটাতেও। আজ অবধি সেখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। এতে আনাগোনা নেই দর্শনার্থীদের।
রোকেয়ার ধ্বংসাবশেষ বাস্তুভিটার পাশেই বাস করেন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘রোকেয়াকে এতো অবহেলা করা হচ্ছে, এটা ভাবলেই অবাক লাগে। বছরের একটি দিন তাকে নিয়ে মাতামাতি করে সবাই। কিন্তু বছরের অন্য দিন খোঁজ নাই। তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিকেন্দ্রটি বেহাল দশা, এটা চালু করা হোক দ্রুতই। পাশাপাশি বাস্তুভিটার ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের দাবি জানাই।’
গাইবান্ধার বোনারপাড়া থেকে রোকেয়ার বাস্তুভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্র ঘুরে এসে হতাশার কথা জানালেন এক দর্শনার্থী। তিনি বলেন, ‘মানুষের মুখে শুনেছি বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্র ও বাস্তুভিটা সম্পর্কে। দীর্ঘদিন থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেখে হতাশ হয়েছি। কখনো ভাবিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের এই বাস্তুভিটা অযত্ন ও অবহেলায় থাকবে। সরকারের উচিত সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এটি সংরক্ষণ করার। তাহলে নতুন প্রজন্মসহ দর্শনার্থীরা রোকেয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।’
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘৯ ডিসেম্বর দিনটি এলেই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে জন্মভিটা রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। এক সপ্তাহ আগে থেকে চলে ধোয়া-মোছা ও পরিষ্কার করার কাজ। অনুষ্ঠিত হয় সভা, সেমিনার। বক্তৃতায় রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগরূক করার জন্য দেওয়া হয় নানান প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং ধ্বংস হতে বসেছে রোকেয়ার বাস্তুভিটা ও স্মৃতি কেন্দ্রসহ সব চিহ্ন।’
তবে বরাবরের মতো সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস উপজেলা প্রশাসনের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, ‘রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা ও বাস্তুভিটা সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মহোদয়কে অবগত করেছি। দ্রুতই এসবের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।’
রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখা, তার জীবন, দর্শন আর রচনা নিয়ে গবেষণার জন্য স্মৃতি কেন্দ্রটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘যেহেতু রোকেয়ার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে, সেহেতু রোকেয়া সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত জানানোর ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। তাই পায়রাবন্দের স্মৃতিকেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে দেওয়ার দাবি জানাই। এমনটা হলে এটি গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা করতে পারবেন শিক্ষকরা-শিক্ষার্থীরা। সেখানে রোকেয়ার দর্শন, চর্চা এবং তার সাহিত্য কর্ম নিয়ে কাজ করার আরও অনেক সুযোগ আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন যেহেতু ছোট তাই এখানে নিয়ে আলাদাভাবে পঠন-পাঠনের সুযোগ কম। বর্তমানে স্মৃতি কেন্দ্রটির কার্যক্রম স্থবির। যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হলে স্মৃতি কেন্দ্রটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মীর তামান্না সিদ্দিকা বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম নাম শুনলেও রোকেয়ার সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান অর্জন করছেন না। রোকেয়ার যে দর্শন, চিন্তা-চেতনা এসব জানতে হলে অবশ্যই রোকেয়ার জন্য প্রতিটি বিভাগের বাধ্যতামূলক কোর্স পড়ানো দরকার। পাশাপাশি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে রোকেয়া সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’
এদিকে রোকেয়ার নামের আগে বেগম শব্দ লেখা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন অনেকেই। তাই ‘বেগম’ শব্দ থেকে মুক্তির দাবি উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘রোকেয়া কখনোই তার নামের আগে বেগম শব্দটি লিখেননি। কিন্তু সকলের কাছে বেগম শব্দটি প্রচলিত করে ফেলেছি। আমাদের এগিয়ে চলার পথে রোকেয়াচর্চা এ সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সকলের মাঝে বেগম শব্দটি যে ভুল ব্যবহার হচ্ছে, সেটি জানান দিয়ে সঠিকভাবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নাম উপস্থাপিত হওয়া উচিত।’
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কোলকাতায় মৃত্যুর পর উত্তর কলকাতার সোদপুরে সমাহিত করা হয় এই মহীয়সী নারীকে। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে দিনটি সরকারিভাবে পালিত হয়।
সারাবাংলা/এনএস