Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফখরুলদের কাউন্সিলিং করানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে

কামরুল হাসান নাসিম
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:৩০

জাতীয়তাবাদ একটি সঙ্গতিপূর্ণ ধারণা, যা জাতিগত স্বার্থকে শুধু উত্তীর্ণ করায় না, নিজেদের উপযোগী শাসনব্যবস্থা উন্নীত করার প্রবণতায় সামিলও হয়। জাতীয়তবাদ প্রশ্নে মোট চারটি মতবাদ আমি রেখেছি। একটি হল, মানচিত্র ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের অনুশীলনকে গ্রহণ করার আদর্শিক অবস্থানকে জাতীয়তাবাদ বলে। অন্যটি হল, একটি জাতির সংস্কৃতিকে লালন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শগুলোর সাথে সু সমন্বয়করত জনশ্রেণির কেন্দ্রীভূত উদ্রেক-ই হলো জাতীয়তাবাদ।

বিজ্ঞাপন

চতুর্থটি, আজ আর উল্লেখ করতে চাই না! বরং, বিব্রত, বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভালো চেয়ে বলতে চাই, সদ্য বন্দি মির্জা ফখরুল ইসলামদেরকে কারাগারে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর দুইটি ক্লাস নিতে পারলে খুব খুশি হতাম। সরকার আমাকে এই সুযোগটি অন্তত করে দিক। তাদেরকে কাউন্সিলিং করানোটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র থেকে দেশের নামধারী রাজনৈতিক দল বিএনপি ফলত অনেক দূরে। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। অথচ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বৈঠকখানায় ধর্না দিয়ে বিএনপির বিদেশনীতির সদস্যরা বলছে, “বাংলাদেশে ভোটতন্ত্র চালু হলে আমরা তোমাদের সকল স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারতাম! দ্যাখো, আমাদের হয়ে যিনি গ্রামীণ চেকের বেশভূষে থেকে তথা গায়ে বস্ত্র চাপিয়ে লড়ছেন, তাকে কে না চেনে ! বিশ্বাস কর হে প্রভু! আমরা খুবই জনপ্রিয়!”

সময় পার হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। এখন তাই তাদের সম্মানিও বেড়েছে। কাদের? এক যুগ আগের কথাই ধরা যাক। পাঁচ হাজার ডলার খরচ যদি করা যেত, যেকোন মার্কিন কংগ্রেসম্যান কে কোনো এক সন্ধ্যা করে তখন শাহজালাল বিমান বন্দরে আনা যেত। এরপর আলাপ সেরে নেয়া। অতঃপর নতুন দিবসে রাজধানী ঢাকার এক সভা সেমিনারে অংশ নিয়ে সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চেয়ে তিনি বা তারা ছবক দিবেন !

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ পরিবেশনে থাকবেন। ফলাও করে তা প্রচার করা হবে। এতে করে আয়োজকের বোঝানোর চেষ্টা যে, দেখলে তো! খোদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারাজ শাসক শ্রেণির ওপর। এই জন্যই গণতন্ত্র চেয়ে কতই না পরিপাটি শক্ত কথা তিনি বলে গেলেন!

এখন রেট বেড়েছে সেই কংগ্রেসম্যানদের। তাদের পেছনে প্রতি বিশেষজন বাবদ ১৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে, হাজির হয়ে যাবেন বাংলাদেশের পাঁচ তারকা হোটেলের কোনো বলরুমে। কিন্তু, কৌশল বদলিয়েছে বিএনপি। এখন তাই তারা মার্কিন শাসনের ফ্রন্ট ডেস্কের কাউকে দিয়েই তাদের মাটি থেকেই বলিয়ে নিচ্ছে যে, এই তোমরা শোন, গণতন্ত্রের বিকাশে যাও, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কর, রাজনৈতিক দলের মতকে সম্মান দেখাও, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি বিদেশি শক্তির এমন সিদ্ধান্তে হালে খুব খুশি হয়ে পড়ছে। মনে ধরা দিচ্ছে সুখ! উপরন্ত মানুষকে তারা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, তারা সঠিক পথে আছে ও বিদেশি প্রভুরাও তাদের পক্ষে। বিএনপি জনমানুষের স্বার্থ নিয়ে ভাবে না কিন্তু জনশ্রেণির সমর্থন প্রত্যাশা করে। এক অভিনব রাজনৈতিক অভিলাষে সিক্ত হয়ে হস্ত দিয়ে আঙ্গুলের আগা দিয়ে গোফ মুড়িয়ে বলছে, দেখা যাবে এবার ! খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে তারা সাধারণ মানুষের মন পেতে এবার ব্যকুলই।

পূর্বসূরী দার্শনিক সক্রেটসকে মনে পড়ল। তিনি একদিন বললেন, “শক্তিশালী মন ধারণা নিয়ে আলোচনা করে, গড়পড়তা মন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে, দুর্বল মন মানুষ নিয়ে আলোচনা করে।” দার্শনিক ঈশ্বরমিত্র বলছেন, “জনশ্রেণির মনের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি করা এক ধরনের প্রহসন। এই শ্রেণিটি হয় অশিক্ষিত, নতুবা ঠক গোত্রের রাজনীতিক।”

একটি রাজনৈতিক দল জনস্বার্থে নিবেদিত থাকবে বলেই তো জন্ম নিয়ে থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষের মনকে নিয়ে উদগ্রীব কারা থাকবে? যারা আজ রাজনৈতিক কর্মী, ওই তারাই কাল নিকৃষ্ট শাসক হবে।

গোষ্ঠীগত চিন্তার উদ্রেকে থেকে বলা যায় যে, বিএনপি মানুষের আস্থা অর্জন করতে চায় কিন্তু দেশের একটি মানুষের জন্যও ইতিবাচক কোনো পরিকল্পনা না করেই। অর্থাৎ দলটি শুধু ঠক নয়, রাজনৈতিক অপশক্তি হওয়ার সকল নেতিবাচক ধর্ম ধারণ করে তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা একটি বুর্জোয়া শক্তি, যাদেরকে চিরতরে নিধন করা ছাড়া আর কোনো রাস্তাও খোলা নেই। তাদের মন জাতীয়তাবাদের মত রাজনৈতিক কৃষ্টিকে ঘিরে উপলক্ষ হয়ে সাংস্কৃতিক গতিপথ নির্ধারিত হয় না। বিএনপির তাবুতে একজন মাত্র শক্তিশালী বিদগ্ধজনও নেই, যার মন আদর্শিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দলটিকে বাঁচাবে। অথচ, দলের নাম জাতীয়তবাদী দল। এই দলের শীর্ষব্যক্তি জাতীয়তাবাদ শব্দটির বানান করতে পারেন না, অথচ তিনি এই দেশের আড়াই বারের প্রধানমন্ত্রী ! পথহারা ও ঘন ঘন আদর্শ পরিবর্তন করা ফরহাদ মজহারও ভাড়াটে বোদ্ধা হিসাবে কথিত জাতীয়তবাদী তাঁবুর এই অশিক্ষিত বাসিন্দাদেরকে শিক্ষিত করতে পারেন নি। আমার ইচ্ছে, তাকেও শিক্ষার্থী হিসাবে কয়েকটা ক্লাস করাতে পারলে ভাল হত।

বিএনপি পুনর্গঠনের উদ্যোক্তা হিসাবেও তো কিছু লিখতে হয়। যেমন, ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারী দলটির পুনর্গঠন চেয়ে বললাম, এই দলের অসুখ ৫টি। অসুখগুলো হল, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বিএনপিকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ, তারা বিদেশি শক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে, দলে জনস্বার্থ সংরক্ষণের রাজনীতি নেই, জাতীয়তাবাদী দলটি জামায়াতেবাদী দলে পরিণত হয়েছে এবং নাশকতার রাজনীতি বেছে নিয়েছে।

‘বিএনপি পুনর্গঠন করার রাজনৈতিক উদ্যোগ ছিল ও আছে। এমন অভিনব রাজনৈতিক লড়াইটি করার বয়স প্রায় আট বছর। ২০১৫ সালে প্রায় ত্রিশটি কর্মসূচি শেষ করার পর ওই বছরের ২৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী জনতার নিম্ন আদালত বসাতে সক্ষম হই।

সেই প্রতীকী আদালতে নিজে বাদী হিসাবে ছিলাম। ‘বিবাদী হিসাবে নির্দিষ্ট সেই পাঁচটি অসুখকে দাঁড় করানো হয়েছিল। এমন প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর প্রতীকী আদালতে আমি উপস্থিত জাতীয়তাবাদী জনতার কাছে দুইটা রায় চাই। এক, দলের গঠনতন্ত্র স্থগিত করা হোক। দুই, একটি ক্রেডিবল কাউন্সিল করার জন্য দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই জাতীয়তাবাদী জনতার উচ্চ আদালত বসতে হবে। তখন বিচারক হিসাবে থাকা জনতা আমার পক্ষে রায় দেয়। তখন আমি দলের পক্ষ থেকে দলীয় বিপ্লব করা হবে বলে ঘোষণা করি।’

২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি, ১৭ জানুয়ারি, ১৭ মে, ৫ সেপ্টেম্বর ও গেল ২৬ নভেম্বর ২০২২-এ কর্মীরা নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে প্রতিবারই তারা মামলার মুখে পড়ে। এই প্রথম আমি ঘোষণা রেখেছি, ১২ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে প্রতিরোধের ভাষায় জবাব দেয়া হবে। ২০২৩ সাল জুড়ে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলবে এবং বিজয়ী হয়ে দলকে পুনর্গঠন করে দেব।

রাজনীতি হলো একটি মিষ্টি খেলা, যা অবুঝ ও মন্দশ্রেণির মানুষের কল্যাণে আবর্তিত। অন্যদিকে পূর্বসূরি প্লেটো গণতন্ত্রের ব্যাখা করতে যেয়ে বলেছিলেন, গণতন্ত্র…সরকারের একটি মোহনীয় রূপ, বৈচিত্র্য ও বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ; এবং সমান এবং অসমকে সমানভাবে এক ধরনের সমতা বিতরণ করায়। এমন উক্তির দৃশ্যমান বাস্তবতা তো বাংলাদেশেই। অবুঝ আর দুষ্ট মানুষগুলো বলবে, অতসব বুঝি না, ভোট দাও।

ঈশ্বর মিত্র বলছেন, “আদর্শিক ভিত্তি না থাকলে যেমন কোনো নামধারী রাজনৈতিক দলকেও অপশক্তি বলা যাবে, আবার অজনপ্রিয় সরকার হয়েও কার্যকর জনস্বার্থ উদ্ধারের মধ্য দিয়েও শ্রেষ্ঠ শাসক হওয়া যায় এবং সেটিই কাম্য। কারণ, সাধারণেরা রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে প্রস্তুত থাকে না।”

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আমি লিখব বা রাজনীতি করব, তা বলতে যাব না। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও মওলানা ভাসানীকে সম্মান করে জাতীয়তবাদী বেশ কিছু সংগঠনের জন্মও হোক। এই বিএনপিকে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব ঝুঁকি নিয়ে নিয়েছিলাম। কথা দিচ্ছি, কাজটি শেষ করব।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক, দার্শনিক ও একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী।

কামরুল হাসান নাসিম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর