‘হাসপাতালে ৫৫ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে’
১৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:২৩
ঢাকা: দেশের হাসপাতালগুলোতে ৫৫ শতাংশ বর্জ্যকর্মী অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি)। মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) ভার্চুয়ালি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত টিআইবির ‘চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
টিআইবি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৯ শতাংশ হাসপাতালের বর্জ্য সংরক্ষণের পাত্রে কালার কোড নেই ও ৫১ শতাংশ পাত্রে সাংকেতিক চিহ্ন নেই। ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর বর্জ্য ও সাধারণ চিকিৎসা বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয় এছাড়া, ১৪ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা-২০০৮। এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংস্থাটির রির্সাচ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা এবং গবেষণা সহযোগী মো. সহিদুল ইসলাম ও সাজ্জাদুল করিম প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণায় চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন কর্তৃক বিদ্যমান চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা, গাইডলাইন, সম্পূরক বিধি এবং নির্দেশিকা প্রয়োগ ও প্রতিপালনে ঘাটতির চিত্র উঠে এসেছে। চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ)-২০০৮ বিধিমালা গত ১৪ বছরেও বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধান করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা থাকলেও তা হয়নি।’
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অন্যতম অংশীজন হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল ও সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টজন বিদ্যমান আইনি কাঠামো এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত না। একইসাথে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট এসকল প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সমন্বয় এবং অংশীজনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করায় ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। হাসপাতাল ও বহির্বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, বাজেট, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি বিদ্যমান।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে বিবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে বিধিবহিভূর্ত আর্থিক লেনদেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলা এবং বিবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলেও তা প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে। ফলে সংক্রমণসহ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায় চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই ক্ষেত্রটিকে যথাযথ প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসা বর্জ্য সংরক্ষণে অনিয়ম চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বর্জ্য সংরক্ষণ পাত্রে বর্জ্যরে ধরন অনুযায়ী কালার কোড থাকা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও হাসপাতালগুলোতে তা প্রতিপালনে ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবে ২৯ শতাংশ হাসপতালের বর্জ্য সংরক্ষণের পাত্রে কালার কোড নেই এবং ৫১ শতাংশ পাত্রে সাংকেতিক চিহ্ন নেই। তাছাড়া বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে হাসপাতালগুলো পাত্রে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে না। কালারকোড থাকলেও বর্জ্যরে ধরন অনুযায়ী অনুযায়ী সঠিক পাত্রে বর্জ্য সংরক্ষণ না করে সব ধরনের বর্জ্য একই পাত্রে রাখা হয়।
পর্যবেক্ষণে আরও দেখা যায়, নির্দিষ্ট পাত্রে বর্জ্য না ফেলে তার পাশে ফেলে রাখা হয়। এ ছাড়া রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আলাদা করা এবং তা সাবধানতার সাথে ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সাধারণ চিকিৎসা বর্জ্য ও কোভিড ১৯ এর চিকিৎসা বর্জ্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় না। সার্বিকভাবে ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর বর্জ্য ও সাধারণ চিকিৎসা বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য পুনঃব্যবহার রোধে ব্যবহৃত রাবার বা প্লাস্টিক নল ও বিভিন্ন ব্যাগ টুকরো করে কাটার নির্দেশনা থাকলেও তা হয় না। সার্বিকভাবে ২৮ শতাংশ হাসপাতালে ব্যবহৃত রাবার বা প্লাস্টিকের ব্যাগ কাটা হয় না। ৩১ শতাংশ হাসপাতালে ব্যবহৃত রাবার বা প্লাস্টিকের নল কাটা হয় না। গাইডলাইন অনুযায়ী পুনঃব্যবহার রোধ করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহত সূঁচ ব্যবহারের পরপরই ধ্বংস বা গলিয়ে দিতে হয়।
দেখা যায়, ৪৯ শতাংশ হাসপাতালে সূচ ধ্বংসকারী (নিডল ডেস্ট্রয়ার) যন্ত্র নেই।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চিকিৎসা বর্জ্য বিক্রি হয়ে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালের দুই ধরনের চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বাইরে বিক্রি করা হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য বিক্রি: হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ (সিন্ডিকেটের অংশ) পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য যেমন, ব্যবহৃত কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ ও রাবার বা প্লাস্টিক নল নষ্ট না করে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহকারীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এসব উপকরণ সঠিকভাবে জীবানুমুক্ত করা হয় না এবং এসব উপকরণ পুনঃব্যবহারের ফলে এইচআইভিসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্রও পেয়েছে টিআইবি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি: চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়। জরিপে দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ বর্জ্যকর্মী নিয়োগ পেয়েছে অনিয়ম ও ও দুর্নীতির মাধ্যমে। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছে ৪৬ শতাংশ, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে ৪২ শতাংশ ও ঘুষ বা বিধিবহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে ১৪ শতাংশ বর্জ্যকর্মী।
এ ছাড়া, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় সাধারণ নিয়োগের সময় চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী হিসেবে আলাদাভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। তাদেরকে সাধারণ বর্জ্যকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তীতে চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বর্জ্যকর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যেমন, বিধি বহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নতুন ও অস্থায়ী কর্মীর শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার পূর্বেই দ্রুত চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়েছে। বর্জ্যকর্মী নিয়োগে বিধিবহির্ভূত ২ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন হয়।
সারাবাংলা/ইএইচটি/ইআ