একটু বাহিরে আসুন, কথা আছে…
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০০:০১
টানা ৯ মাস প্রাণপণ যুদ্ধের পর বাঙালির বিজয় যখন সন্নিকটে, ঠিক তখন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ‘অনিরাপদ’ দরজায় কড়া নেড়ে রুদ্ধশ্বাস আহ্বান, ‘‘স্যার, একটু বাহিরে আসুন, কথা আছে…।’’
শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করা নরঘাতকদের সেই ভয়াল আহ্বানে অনিচ্ছা সত্বেও সাড়া দিয়ে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিন, কবি মেহেরুন্নেসাসহ আরও অনেকেই চিরতরে হারিয়ে যান।
এই হারিয়ে যাওয়ার নিদারুণ গল্পটা ৫৫ হাজার বর্গমাইলে শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শুরুর পর পরই। তবে তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। আর শেষ হয় বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক এক দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সহধর্মিনী বাসন্তী গুহঠাকুরতা তার একটি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নীল নকশার রেখা অংকন শুরু হয়েছিল একাত্তরের পয়লা মার্চের আগেই সত্তরের ১৭ ডিসেম্বর গণভোট বা তারো অনেক আগে উনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় থেকেই, কিংবা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে। একাত্তরে তারা প্ল্যান করে যুদ্ধে নামে। যুদ্ধ তো নয়, কেবল নিরস্ত্র মানুষ নিধন। প্রথমে ওদের এলোপাতাড়ি মারা, তারপর শহরে, গ্রামে-গঞ্জে বেছে বেছে ধনী, ব্যাবসায়ী, বুদ্ধিজীবি নিধন করে নদীতে খালে ফেলে দেওয়া। অনেকে মনে করেন, চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সন্নিকটে— তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল।’
আত্মপ্রবঞ্চক জাতি হিসেবে সেদিনের সেই নৃশংসতার শিকার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্পূর্ণ তালিকা আমরা প্রস্তুত করতে পারিনি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভাষ্য ও নানা তথ্যমতে এ সংখ্যাটা এমন— শিক্ষাবিদ-৯৯১, সাংবাদিক-১৩, চিকিৎসক-৪৯, আইনজীবী-৪২, অন্যান্য-১৬। সরকারিভাবে গত বছর মার্চে প্রথম দফার তালিকায় ১৯১ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। তার পরের ইতিহাস এই অধমের জানা নেই।
কেন এই হত্যাকাণ্ড? স্বজাতি হত্যায় কেন খড়গহস্ত হয়েছিল পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসররা? কী চেয়েছিল তারা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বার বার যে বিষয়টি সামনে এসেছে, সেটি হলো— একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবদের হত্যা করা হয় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা আঁটে। তাদের এই নোংরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর।
একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক জনের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের আরেক সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে— এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের খবর।
তবে এ নিয়ে আহ্লাদে গদ গদ হওয়ার কিছু নেই। এ নরঘাতকদের নির্মুল করা সম্ভব হলেও, তাদের আদর্শকে নির্মুল করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতাদের উত্তর সূরিরা সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈদ্দীন বিদেশে পালিয়ে আছে। এদেশে থাকা তাদের উত্তর সূরিরা যে গোপনে তাদের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে? অধ্যাপক গোপাল কৃঞ্চ মুহুরী, অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদসহ স্বাধীন বাংলাদেশে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনের ভাব শীষ্যরা জড়িত নয়, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান খান অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীন আছে যুক্তরাজ্যে। এই দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো এখন বাঙালি জাতিসত্ত্বাবিরোধী বাংলাদেশিদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। তারা অপেক্ষা করছে মোক্ষম সময়ের। সময় ফিরলে আবার হয়তো জীবিত বুদ্ধিজীবীদের দরজায় শোনা যাবে, ‘‘একটু বাহিরে আসুন, কথা আছে…।’’
লেখক: সাংবাদিক