নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে নওগাঁর অধিকাংশ বধ্যভূমি
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:০৬
নওগাঁ: বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়ে গেছে সারাদেশে। তারই স্মৃতি বহন করে চলছে নওগাঁর বধ্যভূমিগুলো। যদিও অযত্ন ও অবহেলায় এসব বধ্যভূমির অধিকাংশ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
বিজয়ের তিনদিন আগে নওগাঁর মান্দা উপজেলার মনোহরপুর এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে গ্রামটিতে প্রবেশ করে মুক্তিকামী ১৬ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় বলে জানা গেছে।
শহীদ পরিবারের সদস্য মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ওরা (পাক বাহিনী) গ্রামের ১০-১২টা বাড়ি পুড়ায়ে দেয়। পরে গ্রামের পাশে ভালাইন বিলে করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে দু’জন বেঁচে গেলেও ১৬ জন মানুষকে হত্যা করে। তাদের কবরগুলোতে এখন গরু-ছাগল চড়ে বেড়ায়। একটা স্মৃতি ফলক হচ্ছে, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।’
জানা গেছে, ২০১৬ সালে সরকারি উদ্যোগে ওই স্থানে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। সেই বছরই বধ্যভূমির স্থানটিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জমি নিয়ে বিরোধের কারণে পরবর্তীতে প্রাচীর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে এখনো সীমানা প্রাচীর নির্মাণ হয়নি। সীমানা প্রাচীর না থাকায় বধ্যভূমিটি সারা বছর অযন্ত-অবহেলায় পড়ে থাকে।
সম্প্রতি মনোহর বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমির যে স্থানটিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে গরুর গোবর শুকাতে দেওয়া হয়েছে। গণকবরের স্থানটিতে সীমানাপ্রাচীর নেই। ঝোপ-ঝাড়ে ছেয়ে যাওয়া গণকবরের জায়গায় চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি গরু।
মনোহরের মতো নওগাঁর অধিকাংশ বধ্যভূমি এমন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী এই স্থানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তেমনি এক বধ্যভূমি পত্নীতলা উপজেলার হালিমনগর বধ্যভূমি। একাত্তর সালের ৩০ নভেম্বর হালিমনগরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৩৬ জনকে সারিবদ্ধ করে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। হালিমনগর খাল সংলগ্ন ওই বধ্যভূমির স্থানটি চেনার কোনো উপায় নেই। সেখানে কোনো স্মৃতিফলক ও সীমানাপ্রাচীর নেই। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের ত্যাগের এই স্মৃতিচিহ্নটি এখন আবাদি জমি।
২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস নওগাঁ জেলা’ বইয়ের লেখক আইয়ুব হোসেন নওগাঁয় ৩০টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ২০১৯ সালে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ প্রকাশিত গবেষক মোস্তফা-আল-মেহমুদ সম্পাদিত ‘গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ’ নামক বইটিতে ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংগঠনটি প্রায় দুই যুগ ধরে ১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁয় চিহ্নিত ৬৭ বধ্যভূমির মধ্যে ১২টি বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক রয়েছে। এগুলো হলো— সদর উপজেলার দোগাছি ও ফতেপুর, আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া ও শিংসাড়া, রাণীনগরের আতাইকুলা, মান্দার পাকুড়িয়া ও মনোহরপুর, মহাদেবপুরের বাজিতপুর-চকদৌলত, পত্নীতলার হালিমনগর, ধামইরহাটের কুলফতপুর, বদলগাছীর গয়েশপুর ও পাহাড়পুর। এগুলোর মধ্যে নওগাঁর পার-বোয়ালিয়া, মান্দার পাকুড়িয়া, আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া, বদলগাছীর গয়েশপুর ও পাহাড়পুর বধ্যভূমিতে সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। উল্লেখিত এই ৫টি বধ্যভূমি ছাড়া বাকি ৬২টি বধ্যভূমিই অরক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তরুণ গবেষক মোস্তফা আল মেহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, নওগাঁতে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা বেশি হত্যাযজ্ঞ চালায়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্তবর্তী এই জেলার ওপর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলার মানুষ ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল। প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে থাকা এসব মানুষকে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘গণহত্যা ১৯৭১ নওগাঁ’ বইটির প্রথম সংস্করণে নওগাঁয় ৬৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত ১০০টিরও অধিক বধ্যভূমির সন্ধ্যান পাওয়া গেছে।
বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সাক্ষী। এই স্মৃতি চিহ্নগুলো দেখে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্বপ্রজন্মের ত্যাগের কথা স্মরণ করবে এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হবে। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সকল বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সারাবাংলা/এনএস