ইতিহাস লেখা আছে জাদুঘরে
২০ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:৩২
ঢাকা: ইতিহাসের বিভিন্ন স্মারক ও অধ্যায় ধরে রাখে জাদুঘর। একান্ন বছরের বাংলাদেশের সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ। স্মৃতিকথা, সাহিত্য, শিল্প আর সংস্কৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে রয়েছে নানা আয়োজন। তেমনই এক আয়োজন জাদুঘর যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসের নিদর্শন তুলে ধরতে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ২৭টি জাদুঘর। এগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সাতটি। এগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিজয়কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, স্বাধীনতা জাদুঘর, বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
এছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ বিমান জাদুঘর, বাঙালি সমগ্র জাদুঘর, ডাকসু সংগ্রহশালা, বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর ইত্যাদি জাদুঘরেও জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও সংস্কৃতকর্মী মফিদুল হক বলেন, ‘জাদুঘর ইতিহাস সংরক্ষণ করে। এটি সমাজের জীবিত সংযোগ। এতে তরুণ, বৃদ্ধ, শিশুসহ সব বয়স, পেশা ও শ্রেনির মানুষ সমৃদ্ধ ও সংযুক্ত হচ্ছে।’ বর্তমান ডিজিটাল যুগে সশরীরে ঘুরতে যাওয়া কমে গেলেও জাদুঘরের আবেদন কমেনি বলেই মনে করেন বিশিষ্ট এই লেখক ও সংগঠক।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাঙালির গর্ব আর অহংকারের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য ১৯৯৬ সালের ২২শে মার্চ চালু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সে সময় সেগুনবাগিচার একটি পুরনো ভবন ভাড়া নিয়ে সংস্কার করে চালু হয় এ জাদুঘর। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল আগারগাঁওয়ে শূন্য দশমিক ৮২ একর জমির উপর নির্মিত নয়তলা ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বর্তমানে দুর্লভ সামগ্রীসহ ২১ হাজার স্মারক রয়েছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশেষায়িত এই জাদুঘরের বিশেষ লক্ষ্য নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তোলা। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য এ জাদুঘরে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে। একইসঙ্গে জাদুঘরটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর ও গ্রন্থাগারও পরিচালনা করছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দুটি বাসের মাধ্যমে ভ্রাম্যমান জাদুঘর স্থাপন করে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে। এছাড়াও ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির কাজও এগিয়ে চলছে পূর্ণ গতিতে।
সময়সূচি
- রোববার ছাড়া যেকোনো দিন সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত।
- শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত।
- রমজানের সময় সকাল দশটা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত।
প্রবেশ মূল্য
২০ টাকা
বিজয় কেতন জাদুঘর
জাদুঘরের মূল ফটকে দেখা মিলবে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার একটি সম্মিলিত ভাস্কর্য যাদের একজন নারী, যার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। এই বিশেষ ভাস্কর্যটির নাম বিজয় কেতন।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বিজয় কেতন জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের স্মরণে নির্মিত। ২০০০ সালের ২১ নভেম্বরে চালু হওয়া এ জাদুঘরের ছয়টি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বাংলাদেশের সামরিক যোদ্ধাদের নানা কীর্তি, স্মৃতিস্মারক, সেক্টর কমান্ডারদের আলোকচিত্র ও পরিচিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত রাইফেল, কামান, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মরদেহ বহনের কফিন ইত্যাদি প্রদর্শন করা হয়। জাদুঘরের সামনে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য ও সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা নামে দীর্ঘ ম্যুরাল বা দেয়াল চিত্র আছে। এই জাদুঘরটির প্রদর্শনীয় সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দিশালা। এগুলোর নামকরণ হয়েছে ‘হল অব ফেম’। তাছাড়া এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানের মূলকপি, জাতীয় পতাকা, বাংলাদেশের মানচিত্র এবং ধাতুর পাতে খোদাই করে লেখা জাতীয় সঙ্গীত।
পরিদর্শনের সময়
বৃহস্পতি থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, শনিবার ১০টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিজয় কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর খোলা থাকে।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আগে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে এ জাদুঘর স্থাপন করা হয়। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই জাদুঘর। এই বাড়িতেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সেসব স্মৃতি সেভাবেই রাখা হয়েছে উত্তর প্রজন্মের জন্য।
প্রবেশ মূল্য
পাঁচ টাকা। তিন বছরের কম বয়সীদের জন্য কোনো টিকিটের প্রয়োজন হয় না। শুধু শুক্রবার ১২ বছরের কম বয়সীরা টিকিট ছাড়া প্রবেশের সুযোগ পায়।
স্বাধীনতা জাদুঘর
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এখানেই একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ উদ্যানেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর, যা একটি বড় আকারের পরিকল্পিত নকশার অংশ। এই নকশায় রয়েছে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, তিনটি জলাধার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্রবিশিষ্ট একটি ম্যুরাল এবং ১৫৫ আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম।
পুরো নকশাটির প্রধান বিষয় হলো একটি ৫০ মিটার বিশিষ্ট আলোক স্তম্ভ, যা স্বাধীনতা স্তম্ভ নামে পরিচিত। জাদুঘরটি এই স্তম্ভের নিচে অবস্থিত। এটিই বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর।
জাদুঘরটিতে ১৪৪টি কাচের প্যানেলে ৩০০-এরও বেশি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র রয়েছে। এছাড়া রয়েছে টেরাকোটা, ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, যুদ্ধের ঘটনা সংবলিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে প্রচারণা সৃষ্টিতে তৈরিকৃত বিভিন্ন পোস্টার প্রদর্শন করা হয়েছে এখানে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যে টেবিলে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে স্বাক্ষর করেন, তার একটি অনুলিপি রয়েছে জাদুঘরটিতে। তবে মূল টেবিলটি দেখা যাবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে।
পরিদর্শনের সময়
এই জাদুঘরটি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। এর শীতকালীন সময়সূচি প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা। গ্রীষ্মকালীন সময়সূচি প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা। শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে এই জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৫টি ফটক দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘরে যাওয়া যায়। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের নিকটবর্তী ফটক এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিপরীতে অবস্থিত ফটক দিয়ে সহজে প্রবেশ করা যায়।
প্রবেশ মূল্য
২০ টাকা ও শিশু-কিশোরদের জন্য ১০ টাকা। বিদেশিদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা আর সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য ২০ টাকা।
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশে অবস্থিত জাদুঘরটি ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর বীরত্বগাথা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এখানে সেসময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেল, মর্টার, মর্টার শেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, এলএমজি, মেশিনগান, এমএম এলএমজি, বোর রিভলবার, রাইফেল, বোর শটগান, এমএম এসএমজিসহ নানারকম স্মারক প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।
এছাড়াও এখানে বঙ্গবন্ধু গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় দুই হাজার বইয়ের সমন্বয়ে গড়া লাইব্রেরি। এখানে বসে বই তো পড়াই যাবে, কেনাও যাবে।
সময়সূচি
সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার। শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি।
প্রবেশমূল্য
১০ টাকা। এছাড়া ডিসেম্বর মাসে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং সব জাতীয় দিবসে সব দর্শনার্থীরা বিনামূল্যে ঘুরতে পারেন এই জাদুঘরে।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেক সার্কাসের পশ্চিম পাশে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের যে বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, সেটিই আজ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর।
১৯৬১ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন- শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শোনা এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা এই বাড়িতে ভিড় করেছেন ৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে। এই বাড়ি থেকেই ৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি বাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বাড়িতেই ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনককে।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে নাম দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। এখানকার কক্ষগুলোয় এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারবর্গের নানা স্মৃতি চিহ্ন, যা কেবল একটি পারিবারের স্মৃতিচিহ্ন নয়, বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
একতলায় দুটি এবং দ্বিতীয় তলায় তিনটি কক্ষ জাদুঘরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। একতলায় জাদুঘরটির প্রথম কক্ষে ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় এখনো চোখে পড়বে সেই রাতের তাণ্ডবলীলার নিদর্শন। এছাড়া এখানে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি রয়েছে।
এখানে থাকা বিভিন্ন প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস। যেমন- ফুটবল, হকিস্টিক, ক্রিকেট ব্যাট, হেলমেট, সুলতানা কামালের সঙ্গে তার ছবি ইত্যাদি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তো রয়েছেই।
সময়সূচি
বুধবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয়দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি।
প্রবেশমূল্য
টিকিটের মূল্য পাঁচ টাকা। তিন বছরের কম বয়সীদের কোনো টিকিটের প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র শুক্রবার ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য প্রবেশমূল্য ফ্রি।
বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর করার পর ২০১০ সালের ৯ই মে নাজিম উদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর গড়ে তোলা হয় দুটি ঐতিহাসিক জাদুঘর। পাকিস্তান শাসনামলে এই কারাগারে দীর্ঘ সময় বন্দিত্ব কাটানো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি ধরে রাখতে এখানে গড়ে তোলা হয় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারা স্মৃতি জাদুঘর’ ও ‘জাতীয় চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর’। এ দুটি জাদুঘর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের সেলে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীতে জাদুঘর দুটিকে জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের সময় দীর্ঘকাল কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ে ব্যবহার করা নানা সামগ্রী প্রদর্শন করা হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারা স্মৃতি জাদুঘরে। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত খাবার প্লেট, বিছানাপত্র, চেয়ার টেবিলসহ নানা জিনিস পত্র রাখা আছে। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত টেবিল, চেয়ার, চামচ, হাঁড়ি-পাতিল ছাড়াও রয়েছে তার ম্যুরাল। বঙ্গবন্ধুর গোসলখানা ও রান্নাঘরের অংশও জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত। সামনের বকুল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে ছয় দফার স্মারকস্তম্ভ। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লাগানো কামিনী ও ছফেদাগাছও রয়েছে সেখানে।
এই কারাগারেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট চার সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই কক্ষটিতে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর। জাতীয় চার নেতার জেলজীবন ও হত্যার সময়ের স্মৃতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘরটিতে।
এছাড়া এখানে জাতীয় চার নেতার কারাগার জীবনে ব্যবহৃত প্রায় সব কিছুই সংরক্ষিত রয়েছে। সেলগুলোতে দেখা যাবে গুলির চিহ্ন। ঘাতকের অনেক বুলেটই সেলের দেয়ালে বিদ্ধ থাকার চিহ্ন দেখা যাবে। যেসব গুলির চিহ্ন বোঝা যায়, সেগুলোকে সেভাবেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর যেগুলো বোঝা যায় না, তা লাল রঙ দিয়ে বোঝানোর জন্য চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদান ও ভূমিকা এবং তার ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রুমীর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০০৭ সালের ২৪ জুন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় জাদুঘরটি। জাদুঘরটি গড়ে তোলেন জাহানারা ইমামের ছোট সন্তান সাইফ ইমাম জামী। এখানে রয়েছে ইমাম পরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী।
ঠিকানা
বাড়ি-৩৫৫ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সরণি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীত গলির শেষপ্রান্তে।
সময়সূচি
শনিবার সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। মধ্যাহ্ন বিরতির জন্য দুপুর দেড়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে এই জাদুঘর। আর শীতকালে এটি বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ জাদুঘরে কোনো প্রবেশমূল্য নেই।
জাতীয় জাদুঘর
রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রয়েছে আলাদা গ্যালারি। এই জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে আলাদা আয়োজন। ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামের ওপর ‘বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক স্থায়ী প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনীতে ইতিহাসের একটি দীর্ঘ সময়কাল (২৩ জুন, ১৭৫৭- ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১- আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত) একটি স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই দু’টি বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনীতে ‘মাল্টিমিডিয়া প্রজেকশন’ সংযোজন করা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩৮ নম্বর গ্যালারিতে স্থাপিত ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’। সম্প্রতি এ গ্যালারিতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ শিরোনামে একটি কর্নারও স্থাপন করা হয়েছে।
জাদুঘরটি বছরের তিন সময়ে তিন আলাদা সময়ে খোলা হয়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পাঁচ মাস শনিবার থেকে বুধবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত আর শুক্রবার বিকাল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। অক্টোবর থেকে মার্চ পাঁচ মাস শনিবার থেকে বুধবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত আর শুক্রবার বিকাল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর রোজার মাসজুড়ে জাতীয় জাদুঘর শুক্রবার বাদ দিয়ে শনি থেকে বুধবার সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
টিকিটের মূল্য
- বাংলাদেশ ও সার্কভুক্ত দেশের অধিবাসীদের জন্য বিশ টাকা
- ৩-১২ বয়সী শিশুদের জন্য দশ টাকা
- সার্কভুক্ত দেশের বিদেশীদের জন্য বিশ টাকা
- অন্যান্য দেশের বিদেশীদের জন্য একশ টাকা
ডাকসু সংগ্রহশালা
বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্রদের অগ্রগণ্য ভূমিকা জাতীয় ইতিহাসের অংশ। আর সেসব ইতিহাস সংরক্ষণ করতেই ১৯৯১ সালের ৭ই জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় ডাকসু সংগ্রহশালা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিনের সামনে অবস্থিত এই জাদুঘর। এখানে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করা আছে।
সময়সূচি
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ জাদুঘরে কোন প্রবেশমূল্য নেই।
বিমান বাহিনী জাদুঘর
ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম বিমান জাদুঘর। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্যের ইতিহাস, সাফল্য ও উন্নয়নের ক্রমবিকাশকে সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াসে এই জাদুঘর ২০১৪ সালে উন্মুক্ত করা হয়।
এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত বিমান রয়েছে। এমনই একটি বিমান এয়ারটেক কানাডিয়ান ডিএইচ ৩/১০০০। কানাডার তৈরি এই বোমারু বিমানটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করে। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে ভূমি শত্রু থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হান্টার বিমান যা ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে উপহার হিসেবে দেয়। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ডাকোটা বিমান যা ৫ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা বহনে সক্ষম।
সময়সূচি
সোমবার থেকে শনিবার বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এবং বিশেষ দিনব্যতীত প্রতি রোববার বন্ধ থাকে। ৫০ টাকা মূল্যের টিকিট সংগ্রহ করে জাদুঘরে প্রবেশ করা যায়। এছাড়াও ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে ভেতরের হেলিকপ্টার বা বিমানে উঠা যায়।
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত তথ্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর যার আগের নাম ছিল বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর।
১৯৮৭ সালে ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশ পথে সর্বপ্রথম সামরিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলেও দর্শনার্থীদের কথা বিবেচনা করে ১৯৯৯ সালে বিজয় সরণিতে জাদুঘরটিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়।
বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের পশ্চিম পাশে ১০ একর জমিতে নির্মিত এই জাদুঘরে স্বাধীনতার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে। জাদুঘরটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্য নির্ধারিত গ্যালারিসহ ছয়টি পৃথক অংশ রয়েছে এবং প্রতিটি বাহিনীর গ্যালারিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার।
এখানে আর্ট গ্যালারিসহ মাল্টিপারপাস এক্সিবিশন গ্যালারি, ব্রিফিং রুম, স্যুভেনির শপ, ফাস্ট এইড কর্নার, মুক্তমঞ্চ, থ্রিডি সিনেমা হল, মাল্টিপারপাস হল, সেমিনার হল, লাইব্রেরি, আর্কাইভ, ভাস্কর্য, ম্যুরাল রয়েছে।
প্রবেশ টিকিট ও সময়সূচি
জনপ্রতি টিকিট মূল্য ১০০ টাকা। ৫ বছরের কমবয়েসীদের টিকিটের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিট ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্যে প্রবেশ ফি ৫০০ টাকা। টিকিট পাওয়া যাবে অনলাইনেও।
বিজয় বিশদের অন্যান্য সংবাদ-
সারাবাংলা/আরএফ/রমু/আইই
জাতীয় জাদুঘর জাদুঘরে ডাকসু সংগ্রহশালা বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিজয় কেতন জাদুঘর বিমান বাহিনী জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর স্বাধীনতা জাদুঘর