Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কুল্লাপাথার হতে পারে ঐতিহাসিক স্থান

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:৩৪

ঢাকা: দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক ঐতিহাসিক স্থান। মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের এসব সমাধিস্থল আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছেই অপরিচিত। তেমনি একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কুল্লাপাথার শহিদ স্মৃতিসৌধ। এই সমাধিস্থলে ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সংগ্রহ করে দাফন করা হয়েছে। এসব শহিদ মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ১৩ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসে যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ছাত্র শিক্ষকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। ফলে কুল্লাপাথারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। এলাকাটির পাশেই ভারতের আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। এই অঞ্চলটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়। ফলে অন্য যে কোনো এলাকার তুলনায় এখানে যুদ্ধ হয়েছে অনেক বেশি। এসব যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম (প্রয়াত) ব্যক্তি উদ্যোগে আশপাশ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের মরদেহ সংগ্রহ করে তার পৈতৃক ভিটায় দাফন করেন। পাশাপাশি দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি এর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রতিটি কবরের পাশে নামফলক লিখে সংরক্ষণ করেন।

২০২১ সালের ২৭ জুলাই এই দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা করোনায় মারা যান। বর্তমানে তার ছেলেরা প্রশাসনের সহায়তায় কুল্লাপাথার সমাধিস্থলটি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। বর্তমানে যা কুল্লাপাথার শহিদ স্মৃতিসৌধ নামে সারাদেশে পরিচিত।

এ ব্যাপারে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি জায়গায় পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালায়। গণহত্যার শিকার হওয়া এই লাশগুলো তারা বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রাখে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই লাশগুলো বিভিন্ন দেশপ্রেমিক বাঙালি সংগ্রহ করে দাফন করেছেন। পরবর্তীতে এসব স্থান শহিদ স্মৃতিসৌধ কিংবা বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চিহ্নিত এসব ঐতিহাসিক স্থানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবা উপজেলার কুল্লাপাথার ও আশেপাশের এলাকায় শহিদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহগুলো সংগ্রহ করে নিজ ভিটায় দাফন করেন আব্দুল করিম। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি এসব করবগুলো নিজ উদ্যোগে সংরক্ষণ করেছেন। এই স্থানটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। যেখানে গেলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

হারুন হাবিব আরও বলেন, বর্তমানে কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধ যথাযথভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে অনেকগুলো ভবন করা হলেও যথাযথভাবে দেখাশোনা করার কেউ নেই। কুল্লাপাথারসহ সারাদেশের বধ্যভূমিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরতে হবে।

কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধের তত্ত্বাবধায়ক মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের ছেলে মাহবুব করিম সারাবাংলাকে বলেন, আমার বাবা মরহুম আব্দুল করিম দীর্ঘ ৫০ বছর কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধটি রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আমি ও আমার ভাই স্মৃতিসৌধটি দেখাশোনা করছি। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, আমার বাবা তার নিজস্ব ৫০ শতাংশ জমি স্মৃতিসৌধের জন্য, ১৫ শতাংশ জমি স্মৃতিসৌধের ডাকবাংলোর জন্য দান করেছেন। এছাড়াও স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন ১০ শতাংশ জমিতে পুকুরের ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধের অবকাঠামো আমাদের ৭৫ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠেছে।

সেখানে সমাহিত ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে মাহবুব করিম জানান, এদের প্রত্যেকের পরিবারের সঙ্গে আমাদের এখনও যোগাযোগ রয়েছে। সমাহিতদের মধ্যে ৫০ জন শহিদের মধ্যে দুইজন বীর উত্তম এবং দুইজন বিক্রমসহ বেশ কয়েকজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে।

মাহবুব করিম আরও বলেন, কুল্লাপাথার ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। কুল্লাপাথারকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে এখানে একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠবে বলে আশা করছি। কারণ প্রতিনিয়ত এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন শহিদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।

এ ব্যাপারে কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ উল আলম সারাবাংলাকে বলেন, কসবার কুল্লাপাথার একটি ঐতিহাসিক স্থান। স্থানটির পবিত্রতা রক্ষা করতে সারাবছর প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও গ্রাম পুলিশের পাশাপাশি কুল্লাপাথার স্মৃতিসৌধের তত্ত্বাবধায়ক মরহুম আবদুল করিমের ছেলেরা স্মৃতিসৌধটি দেখাশোনা করছেন।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা এখানে পিকনিক করতে এসে জুতা পায়ে শহিদ বেদিতে উঠে সেলফি তোলার চেষ্টা করেন। এ ধরনের কোনো কাজ যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য প্রশাসন থেকে সারাবছর নজরদারি রাখা হয়।

জানা গেছে, কুল্লাপাথারের পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন ৫০ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে দুইজন বীরউত্তম, দুই জন বীর বিক্রম এবং একজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। কুল্লাপাথারের প্রতিটি কবরের সামনে শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ঠিকানা লেখা রয়েছে। এছাড়া সমাধিস্থলের প্রবেশপথে রয়েছে শহিদদের তালিকা। এদের তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় কুল্লাপাথার স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। ২০১০ সালে ৩০ অক্টোবর কুল্লাপাথার সংস্কার করে সমাধিস্থলটির উদ্বোধন করেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়’-এর প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম।

কুল্লাপাথারে সমাহিত শহিদদের তালিকা: হাবিলদার তৈয়ব আলী (সিলেট), সৈনিক দর্শন আলী (ঠাকুরগাঁও), ঢাকার আর কে মিশন রোডের মো. জাকির হোসেন (বীর প্রতীক), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নোয়াব আলী, মো. আবদুল কাইয়ুম, মো. রফিকুল ইসলাম, পরেশ চন্দ্র মল্লিক, মো. আবদুল আউয়াল, মো. জাবেদ আহাম্মদ, মো. মোরসেদ মিয়া, মো. আবদুর রশিদ, সিপাহী শহিদুল হক, সিপাহী আনোয়ার হোসেন, মো. আবদুল অদুদ, মো. ফকরুল আলম, মো. ফারুক আহম্মদ, মোজাহিদ নুরু মিয়া ও মো. আবদুল জব্বার, বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম), কুমিল্লার মো. সাকিল মিয়া, চাঁদপুরের আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতীক), কুমিল্লার সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার, সিপাহী জসিম উদ্দীন, মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী), মো. জামাল উদ্দিন, মো. মোশারফ হোসেন, নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম) (তার নামে ঢাকা সেনানিবাস এলাকার শহীদ মইনুল সড়কের নামকরণ করা হয়), ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, সিপাহী হুমায়ুন কবির, মো. সিরাজুল ইসলাম, মো. ফরিদ মিয়া, সিপাহী আক্কাছ আলী, ময়মনসিংহের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালীর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম), ফরিদপুরের সিপাহী মুসলীম মৃধা, শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম) ও মো. তারু মিয়া, চাঁদপুরের সিপাহী মো. নুরুল হক ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, কিশোরগঞ্জের শ্রী আশু রঞ্জন দে, মো. তাজুল ইসলাম, মো. শওকত, মো. আবদুস সালাম সরকার, মো. আমির হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. মতিউর রহমান এবং অজ্ঞাত তিনজন।

বিজয় বিশদের অন্যান্য সংবাদ-

সারাবাংলা/জিএস/রমু/আইই

কুল্লাপাথার বিজয় বিশদ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর