Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিল্পী সমিতির তত্ত্বাবধানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ৪ দলিল

আহমেদ জামান শিমুল
২২ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৪২

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতের গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এ দেশের শিল্পী, কলাকুশলীদের অনেকেই। তাদের খাবার, থাকার জায়গা আর মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করতে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’। এ সমিতির সবচেয়ে বড় অবদান তাদের তত্ত্বাবধানে ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সহয়তায় চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিলো। এ ছবিগুলো এখন মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছবিগুলো হচ্ছে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘অ্যা স্টেট ইজ বর্ন’, আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’।

বিজ্ঞাপন

প্রথমে নির্মিত হয় ‘স্টপ জেনোসাইড’। আগস্ট মাসেই এটি নির্মাণ শেষ হয় এবং সেপ্টেম্বর মাসে সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হয়। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, নৃশংসতা, নিজের ভিটে বাড়ি ছেড়ে শরণার্থী যারা হয়েছিলো তাদের বর্ণনাতীত দুর্দশার গল্প উঠে আসে। যা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়।

২০২১ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রকাশিত চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামছুল আলম বাবুর গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ‘স্টপ জেনোসাইড’ মূলত এ সংগঠনের আর্থিক এবং হরিসাধন দাসগুপ্তের ক্যামেরা ও কয়েকজন পরিচালকের সহায়তায় নির্মিত হয়।

বাবুর প্রবন্ধ থেকে আরও জানা যায়, আলমগীর কবিরের মধ্যস্থতায় প্রবাসী সরকারের কাছে জহির রায়হান ৮ অক্টোবর ৫টি প্রামাণ্যচিত্র ও একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্মাণের পরিকল্পনা জমা দেন। প্রামাণ্যচিত্রগুলো হচ্ছে ‘অন দ্য ফ্রিডম ফাইটার্স’, ‘অন শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘অন দ্য লিডার্স অব দি লিবারেশন মুভমেন্ট’, ‘টু মিলিয়ন ট্রেইটর্স’, ‘লাইফ ইন দ্য লিবারেটেড এরিয়াস অ্যান্ড অকোপাইড জোনস’ এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি ছিলো ‘বার্থ অব অ্যা ন্যাশন’। সবগুলো চলচ্চিত্রই বাংলা, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় নির্মিত হবে বলে পরিকল্পনায় লেখা ছিলো।

প্রামাণ্যচিত্রগুলো সাদাকালো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে ২০ মিনিট ব্যপ্তির চারটি প্রামাণ্যচিত্রের দৈর্ঘ্য ধরা হয় ২ হাজার ফুট এবং বাজেট ১৫ হাজার টাকা। বাকি প্রামাণ্যচিত্রটির বাজেট ধরা হয় ৯ হাজার টাকা, যার ব্যপ্তি ১০ মিনিট এবং দৈর্ঘ্য ১ হাজার ফুট ধরা হয়েছিলো। পূর্ণদৈর্ঘ্যটি রঙিন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় এবং এর বাজেট ধরা হয়েছিলো ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। যার ব্যপ্তি ধরা হয় দেড় ঘণ্টা এবং দৈর্ঘ্য ৮ হাজার ৫শ ফুট।

বিজ্ঞাপন

‘‘প্রবাসী সরকার জহির রায়হানকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা বাজেট দেয়। সে টাকা দিয়ে উনি বানান ‘অ্যা স্টেট ইজ বর্ন’। যেটিতে ‘লাইফ ইন দ্য লিবারেটেড এরিয়াস অ্যান্ড অকোপাইড জোনস’-এর ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছিলো শেষের রিলে। অন্যদিকে আলমগীর কবির ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ বানান ‘অন দ্য ফ্রিডম ফাইটার্স’-এর নাম পরিবর্তন করে। বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’ বানিয়েছেন ‘টু মিলিয়ন ট্রেইটর্স’-এর নাম পরিবর্তন করে”, জানালেন মীর সামছুল আলম বাবু।

শামসুল আলম বাবু জানান, যেহেতু সরকার প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় অনেক কম টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলো তাই ‘অন শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘অন দ্য লিডার্স অব দি লিবারেশন মুভমেন্ট’ ও ‘বার্থ অব অ্যা নেশন’ বানানোর পরিকল্পনা বাদ দেন জহির রায়হান।

এ ছবিগুলোর সম্পাদনা করেছিলেন আবু মুসা দেবু (দেবব্রত সেনগুপ্ত)। তিনি জানান, এ ছবিগুলো ছাড়াও আরেকটি ছবি নির্মিত হয়েছিলো আব্দুল জব্বার খানের পরিচালনায়। কিন্তু সেটির সম্পাদনা শেষ করতে পারেননি। সেটির কোনো ফুটেজ এখন পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।

“যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন জহির রায়হান বললেন, বিশ্বকে জানানো উচিত এখানে কী হচ্ছে। সে ভাবনা থেকে বানালেন ‘স্টপ জেনোসাইড’। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন তখন কুষ্টিয়ার আম্রকাননে সরকার গঠিত হলো ১৭ এপ্রিল। সেটার উপর জহির রায়হান বানালেন ‘অ্যা স্টেট ইজ বর্ন’। আলমগীর কবির মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং কীভাবে হচ্ছে, তারা কী করছে না করছে— সেটার উপর তিনি বানালেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। আর বাবুল চৌধুরী যেটা করলেন, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাচ্ছিলো ভারতে, তাদের কারো সঙ্গে দুটো বাচ্চা, কারো সঙ্গে একটা বাচ্চা, কারো সঙ্গে তিনটা বাচ্চা— এ বাচ্চাগুলোর অবস্থা কী হবে? তারা কী খেতে পাচ্ছে, কী খাচ্ছে? তাদের চলাফেরা, তারা কীভাবে আছে, তারা সুস্থ না অসুস্থ… এসব নিয়ে বানালেন ‘ইনোসেন্ট মিলোনিয়ার্স’, বলেন আবু মুসা দেবু।

আব্দুল জব্বার খানের যে প্রামাণ্যচিত্রটির ফুটেজ হারিয়ে গেছে বলে আবু মুসা দেবু জানিয়েছেন সেটির ব্যাপারে বাবু জানান, প্রামাণ্যচিত্রটিও প্রবাসী সরকারের সহায়তায় নির্মিত হয়। যার দৈর্ঘ্য ছিলো ১০ মিনিট।

মীর শামছুল আলম বাবু সারাবাংলাকে জানান, ‘স্টপ জেনোসাইড’ পরবর্তীতে প্রবাসী সরকার কিনে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও অন্য দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে বিরাট ভূমিকা রাখে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এপ্রিলের শেষের দিকে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও জহির রায়হান। মে মাসে এটি গঠিত হয়। এর সভাপতি করা হয় জহির রায়হানকে। সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দ হাসান ইমাম। এ সমিতির সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগীত, নাটিকা, একাঙ্কিকা, বিচিত্রানুষ্ঠান করা, বিক্ষোভ মিছিল, কলকাতার বাইরে প্রচার-প্রচারণা, বেতারে অংশগ্রহণ ও কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

সারাবাংলা/এজেডএস/রমু

মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সমিতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর