নাসিরকোট স্মৃতিসৌধ নতুন প্রজন্মের পথপ্রদর্শক
২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:২৮
ঢাকা: সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নাসিরকোট স্মৃতিসৌধ। একাত্তরের এই স্মৃতিস্থানটি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এটি দেশের একমাত্র স্মৃতিসৌধ যেখানে গত পাঁচ দশক ধরেই ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে। দেশের অধিকাংশ বধ্যভূমি বা গণকবর অবহেলিত। স্বাধীনতাবিরোধীরা কোন কোন বধ্যভূমি বা গণকবরের চিহ্ন মুছে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নাসিরকোটে চিরনিদ্রায় থাকা শহিদেরা আছেন দেশপ্রেমিকদের পরম ভালোবাসা ও মমতায়।
হাজীগঞ্জ সদরের বাকিলা থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় নাসিরকোট স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাব সেক্টর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত এ স্থানটি মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাবহুল স্মৃতি বিজড়িত। এই নাসিরকোটেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ জন বীর শহীদ।
নাসিরকোট স্মৃতিসৌধে চিরনিদ্রায় শায়িত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— এম এ মতিন, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. জাহাঙ্গীর আলম, এস এম জহিরুল হক, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. আবু তাহের, মো. আবু তাহের, মো. এমদাদুল হক, এম এ রশিদ গাজী ও এম এ ইলিয়াছ হোসাইন।
জানা গেছে, এই ৯ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজীগঞ্জের ৯টি পৃথক যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। সহযোদ্ধারা তাদের মরদেহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাথে করে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। সেখানেই তাদের সমাহিত করা হয়।
উল্লেখ্য, নাসিরকোট স্কুলে ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। সহযোদ্ধাদের সেখানেই কবর দিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। লিখে রাখতেন সবার পরিচয়। স্বাধীনতার পর প্রথমে কবরগুলোতে শহিদদের নামফলক লাগানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কবর ঘেরা হয় বাঁশের বেড়া দিয়ে। এভাবেই শুরু হয় শহিদদের কবর সংরক্ষণের কাজ।
১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার চেষ্টায় নির্মিত হয় ‘নাসিরকোট স্মৃতিসৌধ’। এরপর কবরস্থান প্রাঙ্গণে বাউন্ডারি দেয়া হয়। বাঁশ পুঁতে ওপরে দেয়া হয় টিনের ছাউনি। তারপর চত্বরটিতে ঢালাই দিয়ে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের দিকে যাওয়া হয়। স্কুলের পাশে গড়ে ওঠে শহিদ স্মৃতি কলেজ। গড়ে তোলা হয় ফুল বাগান। একসময় কবর পাকা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় কবরসহ আশপাশের এলাকা মুড়ে দেয়া হয় টাইলস দিয়ে।
গত চার দশক ধরে যখন যে কর্মকর্তা হাজীগঞ্জ বা চাঁদপুর সদরে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে এসেছেন, প্রত্যেকেই স্মৃতিসৌধের অবকাঠামোগত কোনো না কোনো কাজ করে গেছেন।
সম্প্রতি হাজীগঞ্জ উপজেলার দ্বাদশ ইউনিয়নের নাসিরকোট স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখা হয়। এ সময় এলাকার সাধারণ মানুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্মৃতিসৌধটি সম্পর্কে সারাবাংলাকে নানান তথ্য জানান।
সরেজমিনে দেখা যায়, নাসিরকোট স্মৃতিসৌধের আশেপাশে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, পার্ক ও পুকুর মিলে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে পর্যটকদের মাঝে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন স্কুল কলেজের শত শত শিক্ষার্থীসহ নানান পেশার মানুষ স্মৃতিসৌধটি দেখতে আসেন। শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের প্রতি।
সবিতপুর কলেজের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম ঘুরতে এসেছেন তার বন্ধুদের নিয়ে। আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রায়ই এই পার্কে বেড়াতে আসি। স্মৃতিসৌধ দেখে বিমোহিত হই। শহিদদের শ্রদ্ধা জানাই। সবাই মিলে শহিদদের স্মরণ করি। নাসিরকোট স্মৃতিসৌধের মতো অন্যান্য জায়গাতেও এরকম স্থাপনা থাকলে সবাই উপকৃত হতো। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারতো।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হাজীগঞ্জ উপজেলার ৯টি গ্রামে শহীদ হয়েছিলেন এমন ৯ জনকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নাসিরকোটে সমাহিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়। এরপর যত সরকারি কর্মকর্তাই এখানে দায়িত্বে এসেছেন, তাদের প্রত্যেকেই নাসিরকোট স্মৃতিসৌধের উন্নয়নে নির্মাণে কাজ করেছেন। কেউ স্মৃতিসৌধ মেরামতে কাজ করেছেন, কেউ পার্ক তৈরিতে কাজ করেছেন, কেউ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার উন্নয়নে কাজ করেছেন। আবার কেউ রাস্তাঘাট, পুকুর ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন। এতে এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও নানাভাবে অবদান রেখেছেন।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ‘শহীদদের এই সমাধিস্থল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবে। আর সংবাদমাধ্যমে প্রচারের ফলে এই স্মৃতিসৌধের কথা সারাদেশে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।’
বিজয় বিশদের অন্যান্য সংবাদ-
- ইতিহাস লেখা আছে জাদুঘরে
- মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প শেষ হয়নি ১১ বছরেও
- কুল্লাপাথার হতে পারে ঐতিহাসিক স্থান
সারাবাংলা/ইউজে/রমু