Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বন্ধু যখন কুকুর— অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধন

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৩৩

কুকরকে আদর করছেন ইমা। ছবি: শ্যামল নন্দী।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: নন্দনকানন, নামের মতোই প্রকৃতির নান্দনিকতায় ঋদ্ধ চট্টগ্রাম শহরের এই জায়গা। শতবর্ষী এক বৌদ্ধমন্দির সেখানে, লাগোয়া ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ব্যস্ত পথচারীকেও থামতে হয় কয়েক মুহূর্ত। মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে তাদের চোখে পড়ে, মন্দির প্রাচীরের গ্রিলের সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা চারটি কুকুর, এর মধ্যে একটি প্রায় মুমূর্ষু। এক তরুণী পরম মমতায় সেই কুকুরগুলোকে সেবা দিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

শুধু নন্দনকানন নয়, ব্যস্ত শহরের চেরাগি পাহাড়, মোমিন রোড, আন্দরকিল্লা, ঘাটফরহাদবেগ, সিআরবিসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় দেখা মেলে এই তরুণীর। প্রতিদিন সকাল কিংবা সন্ধ্যায় যেকোনো জায়গায় তিনি কুকুর নিয়ে বসে আছেন, খাওয়াচ্ছেন কিংবা অসুস্থ কুকুরকে সেবা দিচ্ছেন। পথেঘাটে, বাজারে অবহেলায়-অনাদরে থাকা হাড্ডিসার কুকুরগুলো তার কাছে পায় আদর-ভালোবাসা।

বিজ্ঞাপন

পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে শহুরে বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে পরিচর্যা যার দৈনন্দিন যাপিত জীবনের অংশ হয়ে গেছে, প্রাণিপ্রেমী এই মানুষটির নাম ‘ইমা বড়ুয়া’। বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলায়। থাকেন চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের রাজাপুকুর লেন এলাকায়। সঙ্গীত, উপস্থাপনাসহ আরও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ভূগোল বিষয়ে শেষ করেছেন অনার্স-মাস্টার্স। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ শেষ করে যোগ দিয়েছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু চাকরির ছকে বাঁধা জীবন তাকে আটকে রাখতে পারেনি। ব্যাঘাত ঘটছিল কুকুরের পরিচর্যায়ও। পাঁচ মাস পর চাকরি ছেড়ে দেন।

বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়েছিলেন ইমা। বৌদ্ধমন্দিরের সামনে গাছগাছালি ঘেরা ডিসি হিলে কুয়াশা আর গাছের আড়াল ভেদ করে যখন উঁকি দিচ্ছিল রোদ, তখন তার দেখা মেলে। বৌদ্ধমন্দিরের ভেতরে রশি দিয়ে বাঁধা কুকুরগুলোর সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত। সেখানেই সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে জানালেন কুকুর নিয়ে তার জার্নির কথা।

কুকুরদের নিয়ে ইমা বড়ুয়ার যাত্রাটা বেশিদিনের নয়। এর আগে যে অবলা প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো না, এমন নয়। তবে বেওয়ারিশ কুকুরকে ‘ভালো রাখার’ চেষ্টার যাত্রাটা শুরু ২০১৯ সাল থেকে।

‘উপজেলা সদরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলে যাবার সময় দেখতাম, রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা দোকানের ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে খাচ্ছে বাজারের কুকুরগুলো। দোকানের সামনে গেলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে দোকানি, সহ্য করতে হয় আঘাত। অকারণে ঢিল ছুঁড়ে রক্তাক্ত করা হয়। মানুষের আঘাতে কুকুরের মৃত্যু দেখেছি। অসুস্থ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে কুকুরের মৃত্যু দেখেছি। আবার স্বভাবজাত কারণে কুকুরগুলো বাজারের আশপাশের বাড়িঘরেও যেতো না। যদিও যেত গৃহস্থ আর পাড়ার পোষা কুকুরের তাড়া খেয়ে ফিরতে হতো।’

এসব ঘটনা দেখে দেখেই তার কোমল মনে তৈরি হয় কুকুরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। শিশুবেলাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সুযোগ হলে কুকুরদের সেবা করবেন। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে যখন চট্টগ্রাম শহরে থিতু হন, পড়ালেখা শেষে পাওয়া অবসর কুকুর সেবার সেই সুযোগটা এনে দেয়- জানালেন ইমা বড়ুয়া।

“বাসায় একটি কুকুর ছানা কিনে এনেছিলাম। অল্পদিনেই কুকুরটি এমনভাবে জড়িয়ে যায় আমাদের সঙ্গে, যেন সে পরিবারের একজন সদস্য। নাম দিই ‘মনি’। তাকে আমি গোসল করাতাম, খাওয়াতাম, খেলতামও। পড়ালেখা যখন শেষ প্রায়, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম রাস্তাঘাটে অবহেলায় থাকা কুকুরগুলোকে সাধ্যমতো খাওয়াবো, তাদের সেবা করবো।”

তিনবছরে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, আন্দরকিল্লা থেকে সিআরবি পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইমা কোথাও গেলে আশপাশ থেকে কুকুরেরা এগিয়ে আসতে শুরু করে। ঘিরে ধরে তাকে, কখনও বিস্কুট, কখনও পাউরুটি কিনে খেতে দেন কুকুরগুলোকে। এখন প্রতিদিন সকাল হলেই বাসা থেকে কুকুরের জন্য ব্যাগভর্তি খাবার নিয়ে বের হওয়া তার প্রতিদিনকার রুটিন। রাস্তায় অনাহারী কুকুরদের খাইয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে কখনো দুপুর কিংবা বিকেল গড়িয়ে যায়।

এভাবে দিন পার হয়। অনাহারী কুকুরের জন্য আহার জোগানোর এই যাত্রা এখন পৌঁছেছে ক্যান্সারাক্রান্ত কুকুরকে কেমোথেরাপি দেওয়া থেকে দুর্ঘটনায় আহত কুকুরকে সুস্থ করে তোলার মধ্যেও। দিন কয়েক পরপরই অসুস্থ কুকুর নিয়ে তাকে ছুটতে হয় ভেটেরিনারি ক্লিনিকে। কোনোটির জীবন রক্ষা করতে পারেন আবার কোনোটিকে আপ্রাণ চেষ্টার পরও ধরে রাখতে পারেন না। কুকুরের মৃতদেহ সামনে রেখে অঝোরে কাঁদেন।

ইমা’র পরিবারের সদস্য, সংগঠনের সহযোদ্ধা, ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন কুকুর নিয়ে তার এমন আবেগের কথা। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে ইমা তুলে ধরলেন কুকুর বাঁচানোর লড়াইয়ের কয়েকটি অভিজ্ঞতা।

২০২০ সালের মে মাসে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখতে পান, একটি কুকুরের গলার বামপাশে টিউমার ফেটে রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। ইমা কুকুরটিকে বাসায় নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। এরপর নিয়ে যান নগরীর লালখান বাজারের এন্টিডট প্রাণী চিকিৎসা কেন্দ্রে। নিজ খরচে তিনবার কেমোথেরাপি দিয়ে কুকুরটিকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলেন। সুস্থ কুকুরটির বিচরণ এখন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ এলাকায়।

ক্যান্সারাক্রান্ত আরও একটি কুকুরকে একইভাবে প্রায় দেড় বছর চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে সড়কে গাড়িচাপায় প্রাণ হারায় কুকুরটি। সেই শোক এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দিরে যে চারটি কুকুর ছানাকে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি, এক মা কয়েকদিন আগে এই চারটিসহ ছয়টি বাচ্চা জন্ম দিয়ে হারিয়ে যায়। এর মধ্যে দু’টি মারা যায়, জীবিত চারটিকে গত আড়াই মাস ধরে দেখভাল করছেন ইমা। চারটির নামও দিয়েছেন তিনি। ‘গুড্ডু, ‘মিশা’, ‘লিজা’, ‘ডেজি’ বলে ডাক দিলেই আওয়াজ তুলে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে ওরা। এর মধ্যে মিশা আক্রান্ত হয়েছেন ‘পার্ভো’ ভাইরাসে, রক্তবমি করছিল। দুপুরে মিশাকে কোলে নিয়ে ছুটেন লালখান বাজারের সেই ক্লিনিকে।

‘ডাক্তার বলেছেন, এটা ছোঁয়াচে। এর সংস্পর্শে থাকলেও অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হবে। গুড্ডু, ডেজি, লিজার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে, তাদের কী হবে জানি না।’

ইমা জানালেন, গত তিন বছরে নানা রোগে আক্রান্ত ও আহত অর্ধশতাধিক কুকুরের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এর মধ্যে হাতেগোণা দু’য়েকটি ছাড়া বাকিগুলো নতুন জীবন পেয়েছে তার হাত ধরেই।

কুকুর নিয়ে ইমা’র এই কর্মকাণ্ড প্রথমদিকে তার পরিবারের সদস্যরাও ভালোভাবে নেননি। তবে দিন শেষে এখন পরিবারের সদস্যরাই তার পাশে আছেন। কুকুরের আহার আর চিকিৎসা খরচের জোগান দিচ্ছেন বাবা-বোনেরা।

‘প্রথমদিকে ঘরে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে যদি সারাদিন কেউ কুকুর নিয়ে পড়ে থাকে, যেকোনো বাবা-মা রাগ করবেন। কিন্তু এখন বাবা নিজেই কুকুরের চিকিৎসার টাকা দেন। খাবার কেনার জন্য বড় বোনেরা টাকা পাঠান। কুকুরের জন্য আমি পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের কারও কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পাইনি, আমি চাইওনি কারো কাছে।’

তবে কুকুরের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আচরণ কখনও এমন নির্দয় হয়ে ওঠে, কষ্ট পান ইমা। অনেকসময় প্রতিবাদ করেন, অনেকসময় নীরবে চোখের জল ফেলেন।

‘দেখা গেছে, আমি কোনো আহত কুকুর বা কুকুরের বাচ্চাকে উদ্ধার করে এনে একটা জায়গায় রেখেছি, আশেপাশের মানুষ বাচ্চাগুলোকে অন্য জায়গায় নিয়ে ফেলে দিয়েছে। কোনো পাড়ার ভেতরে কুকুরকে খাওয়াতে গেলে লোকজন বিভিন্ন কটু কথা বলে। কিন্তু আমি দমে যাবার পাত্র নই। আমি প্রতিবাদ করি। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কিংবা থানায় অভিযোগ করার ভয় দেখানে তারা বরং কিছুটা দমে যায়।’

ইমা বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘কুকুর কিংবা যে কোনো প্রাণী, তারা তো নিষ্পাপ। তারা কোনো অন্যায় করে না। আঘাত পেলে যেমন মানুষের খারাপ লাগে, ঠিক তেমনি আঘাত পেলে কুকুরদেরও খারাপ লাগে। তাদের সঙ্গে মানুষ কেন এমন আচরণ করে, আমার খুব কষ্ট লাগে। আমরা মানুষ। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। অথচ আমাদের আচরণ অবোধ প্রাণিগুলোর চেয়েও খারাপ।’

ছবি: শ্যামল নন্দী

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এমও

কুকুর বন্ধু যখন কুকুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর