Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোজ গার্ডেন টু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, অনূভূতিতে যত সম্মেলন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৩৪

ঢাকা: রোজ গার্ডেন থেকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। পথচলার ৭৪ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ— তিনটি শব্দমালা যেন দেশের স্বাধীনতা, স্বাধীন মানচিত্র আর স্বাধীন পতাকার সমার্থক। তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য সংগ্রাম ও অর্জনের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার পথচলার নামও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গণমানুষের পরিবার, প্রিয় অনুভূতির দলটি রাত পোহালেই ২২তম জাতীয় কাউন্সিলের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৮১ সাল থেকে দলটির নৌকার হাল ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা টানা মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

করোনা অতিমারির ধাক্কা কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় সংশয়-সংকটেও পথচলার গতিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতার লক্ষ্যে ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দলের সভাপতি হিসেবে এবারও স্বপদে বহাল থাকছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সম্মেলনে ১১তম সভাপতি নির্বাচিত হলে বিগত সময়ের মতো আবারও দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুভার পাবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ধারা। আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেওয়া উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি চলতি বছরে ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলনে কালের গহ্বরে হাজারও নেতাকর্মীর রক্ত সংগ্রামের ও আত্মদানে দলটি এখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও পরিবারিক অনুভূতির মহীরূহে পরিণত হয়েছে।

পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে যে দলটির প্রতিষ্ঠা, সেই দলটি এখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সুরম্য ১০ তলা নিজস্ব কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য, প্রাজ্ঞ, কৌশলী ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতাতেও আসীন হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনে জয়লাভের প্রত্যয় নিয়ে আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনিমার্ণের অঙ্গীকার ব্যক্ত হবে দলটির ঘোষণাপত্রে। যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ইশতেহার হিসাবে জনগণের সামনে স্মার্ট বাংলাদেশে বিনিমার্ণের প্রত্যয়নামা হবে।

সেই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির রাত পোহালেই ২২তম জাতীয় সম্মেলন। আগামী তিন বছরের জন্য নবতর প্রত্যয়-প্রত্যাশার অঙ্গীকার পূরণে নেতৃত্ব নির্বাচন করার ক্ষণে দাঁড়িয়ে দলটি। গত ২০তম জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।’ সেই ‘অনুভূতি’র সম্মেলনের দ্বারপ্রান্তে আওয়ামী লীগ। ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনে দলটির ২২তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন এবং কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।

এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপরিহার্য ধরে তার নেতৃত্বে পরবর্তী তিন বছরের জন্য নতুন একটি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সম্মেলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দলটি। দলীয় প্রতীক নৌকার আদলে বিশাল মঞ্চে উপবিষ্ট হবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলর, ডেলিগেটদের জন্য মঞ্চের সামনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে হাজার হাজার আসন। মঞ্চের পিছনে প্রতীকী শোভাবর্ধন করছে প্রমত্ত পদ্মার বুকে ৪০টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মা বহুমুখী সেতু, তরুণে প্রজন্মের মেট্রোরেল। বিশালাকার পালতোলা নৌকায় আবহে জ্যোতি ছড়াবে মূল মঞ্চ। মূল মঞ্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি। এছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম চার নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ছবিও রয়েছে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এপর্যন্ত ২১টি জাতীয় সম্মেলন অতিক্রম করেছে দলটি। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কে এম দাশ লেনের কে এম বশির হুমায়ূনের বাসভবন ‘রোজ গার্ডেনে’ (হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি বলে পরিচিত) মুসলিম লীগের খাজা নাজিমউদ্দিন ও অফিসিয়াল নেতৃত্বের বিরোধী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অংশটি গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আয়োজন করে। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই কর্মী সম্মেলনের প্রথম দিনেই একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সেসময় গঠিত হয় ৪০ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটি।

১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের একটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্টে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ও ২১ দফা অনুমোদন দেওয়া হয়।

১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, জোট নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ এবং অবিলম্বে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই কাউন্সিলে আওয়ামী লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করার লক্ষ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়। ওই কাউন্সিলে সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী অনুসারী এবং ভাসানী অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ্য বিরোধে পরিণত হয়। কাগমারী সম্মেলনের পর ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পদত্যাগপত্র পাঠান। অন্যদিকে ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করা হয়। এই কাউন্সিলে ভাসানীর পদত্যাগপত্র নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু গৃহীত হয় না। দল থেকে পদত্যাগ করলেও কাউন্সিল ভাসানীকেই সভাপতি করা হয়। সেই সাথে সহসভাপতির তিনটি পদ শূন্য ঘোষণা করে নতুন কমিটি নির্বাচন করা হয়। এই কমিটিতেও সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু।

১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ে তোলা হয়। সেনা শাসক আইয়ুব খান কনভেনশন মুসলিম লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, জামায়াতে ইসলামী ও নিজাম-ই-ইসলামী প্রভৃতি দলও পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর পর এনডিএফ কার্যকারিতা হারায়। ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা। এই সভায় দলকে নতুন করে উজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকে, আর সভাপতির দায়িত্ব পান মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ।

১৯৬৪ সালের ৬, ৭ ও ৮ মার্চ ঢাকার হোটেলে ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। দলের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের উদ্বোধন করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। এই কাউন্সিলে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে পুস্তিকাকারে ৬-দফা বিতরণ করা হয়। কাউন্সিল ৬-দফা অনুমোদন করে। এই কাউন্সিলে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন মওলানা তর্কবাগীশ। এই কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব পায় আওয়ামী লীগ। নতুন ওয়ার্কিং কমিটিতে সভাপতি হন টানা ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা বঙ্গবন্ধু। তার রানিং মেট, অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান তাজউদ্দীন আহমদ।

পরের বছর ১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে পিডিএম-এ অংশগ্রহণ না করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। পরে ১৯৬৮ সালের ১৯ ও ২০ অক্টোবর হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণের কাউন্সিলে গঠিত হয় নতুন কমিটি। তবে তাতে শীর্ষ দুই পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৪ ও ৫ জুন। হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই কাউন্সিলে এক হাজার ১৩৮ জন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন। এই কাউন্সিলটি ছিল উদ্দীপনা ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি মিলন মেলা। কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই কাউন্সিলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয় এবং ৬-দফা আদায়ের লক্ষ্যে নির্বাচনকে একটি গণভোট হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। এই কাউন্সিলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমদের বিকল্প খুঁজে পায়নি আওয়ামী লীগ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ৭ ও ৮ এপ্রিল। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্বাহী সংসদের অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্য মনোনয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাউন্সিলে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিলের পূর্ব পর্যন্ত মেয়াদের জন্য ৪৪ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেন। ওই কমিটিতে সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিনের জায়গায় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান জিল্লুর রহমান।

১৯৭৪ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ নীতি নির্ধারণী ভাষণ দেন। এই কাউন্সিলে দলের নেতৃত্বে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের দলের নেতৃত্বস্থানীয় পদে থাকার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৃষ্টি হয় গণতন্ত্র চর্চায় নতুন ঐতিহ্য। কাউন্সিলে এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগ। এই সম্মেলনই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ সম্মেলন।

পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি জারি করা হয়। ৩০ জুলাই ঘরোয়া রাজনৈতিক তৎপরতার শুরুর অনুমতি দেওয়া হলে ২৫ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতাদের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। বর্ধিত সভায় মহিউদ্দিন আহমেদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইডেন চত্বরে দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কাউন্সিলের আগেই দলের নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্যের অভাব প্রকাশ্য দলাদলির রূপ ধারণ করে। কাউন্সিল প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান চৌধুরী দলের সভাপতি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু দলের মূলধারার নেতাকর্মীরা মিজান চৌধুরীর নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ৩ ও ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলেও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। দলের গুরুত্বপূর্ণ বহুসংখ্যক নেতা কারারুদ্ধ থাকায় ওই কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত হয়, আপাতত পূর্ণাঙ্গ কমিটি না করে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হবে। সে অনুযায়ী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ১০ দিনের মধ্যে ৪৪ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয়, কারারুদ্ধ নেতারা মুক্তির পর ৪৪ জনের কমিটির সঙ্গে যুক্ত হবেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন ১৫ এপ্রিল সাংগঠনিক কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। ওই কমিটিতে আহ্বায়ক হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।

১৯৭৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মার্চ তিন দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ৫ মার্চ কাউন্সিলের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক।

ওই বছরই মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠনের চেষ্টা করা হয়। ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিভক্ত আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একটি কমিটিও গঠন করা হয়। মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ওই কমিটি গঠনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯৭৮ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে দলত্যাগীদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ১১-দফা কর্মসূচি অনুমোদন হয়।

১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে। আওয়ামী লীগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই কাউন্সিলে দলে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ এবং দলকে অধিকতর শক্তিশালী ও সুসংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন। এই কাউন্সিলেই প্রথম গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক ‘সভাপতিমণ্ডলী’ গঠিত হয়।

এদিকে, ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলে সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং দলত্যাগীদের বহিষ্কার করা হয়।

১৯৮৭ সালের ১, ২ ও ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও সাজেদা চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কার্যনির্বাহী সংসদ গঠিত হয়।

১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিন ২০ সেপ্টেম্বর নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালার আলোকে দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের সংশোধনী সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয় নতুন কমিটি। তাতে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকলেও সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরে আসেন জিল্লুর রহমান।

এরপর ১৯৯৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বরে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন এবং ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিলের জন্য একবছর সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই কাউন্সিলে কোনো নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।

১৯৯৭ সালের ৬ ও ৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে গঠন করা হয় নতুন কমিটি। তাতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এরপর ২০০০ সালের ২৩ জুন পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের জন্য একবছর সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। কাউন্সিলের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। নির্বাচিত হয় নতুন নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন মো. আবদুল জলিল।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পরের কাউন্সিলটি অনুষ্ঠিত হয় সাত বছর পর। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় সেই সম্মেলন। তাতে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা বহাল থাকলেও বদল আসে সাধারণ সম্পাদক পদে। জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব।

২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ১৯তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। একদিনের এই কাউন্সিলে ঘোষণাপত্রের সংশোধনী গৃহীত হয়। সেবার গঠনতন্ত্রে কোনো সংশোধনি আনা হয়নি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও আসেনি পরিবর্তন। কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু কিছু পদে আসে নতুন মুখ।

২০১৬ সালে ২২ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদ্বোধন করা হয় আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। পরদিন ২৩ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছিল কাউন্সিল অধিবেশন। বরাবরের মতো এই সম্মেলনেও নৌকার হাল তুলে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে। তবে ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ নিজেই নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করেন ওবায়দুল কাদেরের নাম। সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীতও হয়। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও আসে বেশকিছু পরিবর্তন।

২০১৯ সালে ২০ ও ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনে দলটির ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সভাপতি হিসাবে দশমবারের মতো দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আর টানা মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ঐতিহ্য সংগ্রাম গৌরবগাথায় ২১টি জাতীয় কাউন্সিল পেরিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন দাঁড়িয়ে আছে ২২তম কাউন্সিলের দ্বারপ্রান্তে। রাত পোহালেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সূচনা হবে এই কাউন্সিলের। শনিবার দুপুর তিনটায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হবে কাউন্সিল অধিবেশন। এই সম্মেলনেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শেখ হাসিনার হাতেই থাকছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে তার রানিংমেট, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরই তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবেন নাকি নতুন মুখের দেখা মিলবে— তা নিয়েই এখন যত জল্পনা-কল্পনা। আর সেই জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে শনিবারের কাউন্সিল অধিবেশনে।

সারাবাংলা/এনআর/একে

আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের সম্মেলন রোজ গার্ডেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর