Sunday 22 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঘরে ফেরার বিষাদ


১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:২৭ | আপডেট: ২৫ জুন ২০১৮ ১৯:৪৭

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

খাবারের খোঁজে মানুষকেও পাখিদের মতো বাইরে বেরোতে হয়। পেছনে পড়ে থাকে সন্তান, সংসার আর ফেলে আসা সঙ্গীর স্মৃতি। খাবারের সন্ধান শেষে ‘আলো চোখে জাহাজীর’ মতো মানুষেরাও প্রতিদিন ঘরে ফেরে। তবে মানুষের ফেরাটা পাখিদের মতো নির্ঝঞ্ঝাট হয় না। অন্তত শহর ঢাকায় পাখিরা যতোটা স্বাধীন, মানুষেরা ততোটা নয়। তাই মানুষের ফেরার পথে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় সড়ক বাতির লাল চোখ, বেরসিক ট্রাফিক সিগন্যাল আর জেব্রাক্রসিংয়ের পরাবাস্তব দেয়াল। সঙ্গে দীর্ঘলাইনে জমে থাকা যানজট।  তাই প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের ঘরে ফেরার আনন্দও বদলে যায় বিষাদে।

দিন যতো যাচ্ছে শহর ঢাকা ততোই পরিণত হচ্ছে জ্যান্ত যানের ভাগাড়ে। চুরি যাওয়া ফুটপাথ, যত্রতত্র পার্কিং আর কর্তৃপক্ষের নিদারুণ উদাসীনতায় শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাও হয়ে পড়েছে অকার্যকর। এখানে দশ মিনিট দূরত্বের রাস্তা পেরোতে খরচ করতে হচ্ছে দুই ঘণ্টা বা তারও বেশি সময়। দিন বদলের যেন কোন সুযোগ নেই তাই সিগন্যালে লটকে থাকাকে নিয়তি বলেই মানছেন সবাই। এরপরও একটু ভালো রোজগার অথবা একটু ভালো ভাবে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে মানুষ বাড়ছে রোজ। এই বাড়তি মানুষের চাপ সামলাতে গিয়েও যানজটের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে যাচ্ছে গোটা শহর।

মানুষের আধিক্য ও সড়কের ওপর দিয়ে পথচারী পারাপার এ শহরে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। এটি এড়াতে নগরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে রয়েছে ৬৬টি ফুট ওভারব্রিজ। রয়েছে তিনটি আন্ডারপাসও। তবে পথচারী পারাপারে এগুলো তেমন কোন কাজেই আসছে না। তারা সিগন্যাল পয়েন্টে কিংবা সিগন্যাল ছাড়াই যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছেন, চলন্ত গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

যানজট কমাতে বিগত বছরগুলোতে নির্মিত হয়েছে নয়টি ফ্লাইওভার। যার নির্মাণ ব্যয় ছিলো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। কিছু কি সমাধান হয়েছে তাতে? সে প্রশ্ন করাই যায় কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে ফ্লাইওভারের দুদিকসহ যানজট হচ্ছে ফ্লাইওভারের ওপরেও। ফলে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিও কমছে আশংকা জনক হারে।

বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, এক দশকে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে নেমে এসেছে মাত্র সাত কিলোমিটারে। কয়েক বছরের মধ্যে তা ঘণ্টায় চার কিলোমিটারে চলে আসবে, যা মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতির চেয়েও কম।

বহির্বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা থাকলেও ঢাকায় আছে মাত্র সাত থেকে আটভাগ রাস্তা৷ ফলে রাস্তার অপ্রতুলতাও এ শহরে জ্যামের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ। ঢাকা শহরের মোট ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়কের ৩০ ভাগ দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিংসহ এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে৷ এরমধ্যে বেশীরভাগ ফুটপাথ হকার ও ভাসমান মানুষদের দখলে থাকায় পথচারীরাও হাটতে পারছেন না নির্বিঘ্নে।

এছাড়াও স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি’র হিসাব হিসেব থেকে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী ৩০ ভাগ রাস্তায় যোগাযোগের জন্য গণপরিবহন ব্যবহার করেন৷

ঢাকা শহরের জ্যামের আরেকটি কারণ এর বুক চিড়ে রেলগাড়ির চলাচল। ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে এর ১৭টি পয়েন্টে কিছু সময় পরপরই রাস্তা বন্ধ করে রাখতে হয়। এ সব পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১৫ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়৷

বিজ্ঞাপন

এগুলো ছাড়াও ঢাকার যানজটের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ জানান ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম। তিনি বলেন, ‘ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ছাড়াই আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা, সড়ক বিবেচনা না করে গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেয়ার কারণে ঢাকায় যানজট বাড়ছে। এছাড়া মহানগরীর ভেতরের প্রকল্পগুলোর নির্মাণ কাজে ধীর গতির কারণেও যানজট হচ্ছে।’

প্রায় ২ কোটি মানুষের শহর ঢাকায় যানজটের ফলে যে শুধু সময় নষ্ট হয় তা নয়, ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও৷ এটির প্রভাব পড়ে দেশজ অর্থনীতিতে। বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্ট বা বিওআই’র ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বাংলাদেশে বছরে যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তার মূল্য ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা৷ এছাড়া উৎপাদন খাতে আর্থিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি, স্বাস্থ্যগত ২১ হাজার ৯১৮ কোটি, জ্বালানি ও যানবাহন মেরামত বাবদ ১ হাজার ৩৯৩ কোটি এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয় ১৫৪ কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে বছরে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা৷

তবে যানজট কমাতে নগর কর্তৃপক্ষ হাতে নিয়েছিল বেশ ভালো কিছু উদ্যোগ। যার বেশীরভাগই শেষ পর্যন্ত ব্যার্থতায় পর্যবশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি বড় রাস্তা থেকে গাড়ী পার্কিং উচ্ছেদ করলেও পড়ে তা আবার দখল হয়েছে। পথচারীদের আকর্ষণ করতে ফুট ওভারব্রিজগুলো সাজানো হয়েছিলো নানা জাতের ফুলগাছ দিয়ে। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে বনানী ও বিমানবন্দর সড়কের ফুট ওভারব্রিজে সংযোজন করা হয়েছিলো চলন্ত সিঁড়ি। সেগুলো কাজে আসেনি। বরং এসব ফুট ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পাড় হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এছাড়াও যানজট নিরসনে চালু রয়েছে মহাখালী ওভারপাস, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি-তেজগাঁও লিংক রোড ওভারপাস, টঙ্গী ওভারপাস, বনানী ওভারপাস, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। তবে যানজট নিরসনে এই উড়াল সেতুগুলোও ব্যবহার করার পরও যানজট না কমে বরং বাড়ছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে ডেমু ট্রেন ও ওয়াটার বাস সার্ভিসও।

এছাড়া ঢাকার রাস্তায় সিগনাল বাতি, সড়কে কাঁটাযুক্ত প্রতিরোধযন্ত্র, পৃথক লেনের ব্যবস্থাসহ আরো বেশ কিছু উদ্যোগও যানজট নিরসনে কোন কাজে আসেনি।

যানজট সমস্যা সমাধানের কি উপায় জানতে চাইলে ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বলেন, ‘এ সমস্যা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট যতগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যানজট কমিয়ে আনা সম্ভব।’

‘এছাড়া ফুটপাথ যদি দখলমুক্ত করা যায় আর অবৈধ পার্কিং যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে যানজট অনেকাংশেই কমে আসবে,’ বলেন তিনি।

সারাবাংলা/তুসা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিপর্যস্ত ফ্লিক চান 'বিরতি'
২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:১৬

আরো

সম্পর্কিত খবর