Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর বছর

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৫৯

ঢাকা: দলীয় প্রধানের কারাবাস, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্বাসন এবং একের পর এক ‘ভুল রাজনীতির’ ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন ‘ব্যাকফুটে’ থাকা বিএনপির ২০২২ সালটা ছিলো ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। বিদায়ী বছরটা বিএনপি শুরু করেছিল দলীয় প্রধানের স্থায়ী মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে।

বছরটা শেষ হচ্ছে সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, আরপিও সংশোধন করে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল এবং খালেদা জিয়াসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আটক নেতাদের মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগরে গণমিছিলের মধ্য দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

বছর শুরুর মাসগুলোতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় একটা সময় কেটেছে হাসপাতালে। শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। সরকারের নির্বাহী আদেশে ‘সাময়িক মুক্তি’র মেয়াদ আরও ২ দফা বাড়ায় এখন তিনি গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় অবস্থান করছেন। বাধ্যবাধকতা এবং অসুস্থতার কারণে বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরটাতেও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি বেগম খালেদা জিয়া।

তার অনুপস্থিতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে খুব ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বিএনপি। ৯টি বিভাগীয় গণসমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তভাবে ফিরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিল দলটি। কিন্তু আবার সেই ছন্দপতন। দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার ‘১০ ডিসেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে’, ‘পল্টন গণসমাবেশে সশরীরে উপস্থিত হবেন বেগম খালেদা জিয়া’— এ ধরনের ‘বালখিল্য’ বক্তব্যের কারণে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

অতিকথন আর বাড়াবাড়ির জের ধরে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে নিহত হন একজন। আহত হন অর্ধ শতাধিক। গ্রেফতার হন বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে গ্রেফতার হন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের প্রধান উপদেষ্টা দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে কারাগারে রেখেই সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতার ভিত্তিতে‘ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জন্য একেবারেই অপরিচিত ভেন্যু ‘গোলাপবাগ মাঠে’ গণসমাবেশ করে বিএনপি। এরপরও সমাবেশে ‘বিপুল সংখ্যক’ লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি।

গোলাপবাগ মাঠ থেকে ১০ ডিসেম্বর ১০ দফা ঘোষণার পর ১৯ ডিসেম্বর ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ ২৭ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে জাঁকজমকপূর্ণ ওই আয়োজন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোনো আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি বিএনপির ২৭ দফা।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে দল পরিচালনার মাধ্যমে দলীয় অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি সমমনাদের সঙ্গে দুই দফায় টানা ছয় মাস সংলাপ এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে যে রূপরেখা তৈরি করেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, তার অনুপস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে সেই রূপরেখা ঘোষণা করায় বিএনপির অভ্যন্তরে ‘নেতৃত্ব’ নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং একে অপরের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

বিদায়ী বছরে আরেকটি আলোচতি ঘটনা ছিল জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগ। ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠ থেকে তারা পদ্যাগের ঘোষণা দেন এবং ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে গিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দেন বিএনপির পাঁচ এমপি। পরবর্তী সময় বাকি দুই এমপিও পদত্যাগ করেন।

বিদায়ী বছরের ১২ মাসে বিএনপির ১৩ আলোচিত ঘটনা

১. বিভাগীয় শহরে ১০টি ‘সফল’ গণসমাবেশ
চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিএনপির আন্দোলনে ভোলার নুরে আলম ও আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সিগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন ও যশোরে আব্দুল আলিম মোট ৫ জন হত্যার প্রতিবাদে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদে ১০ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করে বিএনপি। বিদায়ী বছরের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির এই গণ-সমাবেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন কোণঠাসা থাকা বিএনপি প্রচণ্ডভাবে ঘুরে দাঁড়ায়।

২. গোলাপবাগ মাঠ থেকে ১০ দফা ঘোষণা
ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে বিদায়ী বছরের ১০ ডিসেম্বর ১০ দফা তুলে ধরে বিএনপি। দফাগুলোর মধ্যে রয়েছে— বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন, খালেদা জিয়াসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন, গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান।

৩. ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ ২৭ দফা
জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’ এর আলোকে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা দেয় বিএনপি। ১৯ ডিসেম্বর বিকেলে গুলশানের ‘দ্য ওয়েস্টিন হোটেলে’ জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে এ রূপরেখা ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

২৭ দফার ওই রূপরেখায় ‘পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিতে পারবে না’ এবং ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হয়।

৪. সমমনাদের সঙ্গে সংলাপ
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য বিদায়ী বছরটাতে সমমনাদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিদায়ী বছরের ২৪ মে নাগরিক ঐক্য, ২৭ মে লেবার পার্টি, ৩১ মে গণসংহতি আন্দোলন, ১ জুন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ২ জুন কল্যাণ পার্টি, ৭ জুন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ৮ জুন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ৯ জুন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ১২ জুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), ১৬ জুন কর্নেল (অব.) ডক্টর অলি আহমদ নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ১৯ জুন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ২১ জুলাই বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), ২৪ জুলাই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), ২৬ জুলাই ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামিক পার্টি, ৩১ জুলাই বাংলাদেশ পিপলস লীগ, জাতীয় দল ও বাংলাদেশ ন্যাপ, ২ আগস্ট মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম এবং ৩ আগস্ট গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপ করে বিএনপি।

দ্বিতীয় দফায় ২ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ৩ অক্টোবর কর্নেল (অব.) ডক্টর অলি আহমদ নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ৬ অক্টোবর লেবার পার্টি ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ১০ অক্টোবর জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও মুসলিম লীগ, ১৮ অক্টোবর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ২৩ অক্টোবর ন্যাপ ভাসানী ও পিপলস লীগের সঙ্গে সংলাপ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

৫. রাজধানীর ১৬টি স্পটে সমাবেশ
জ্বালানি তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এবং ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে দলের তিন কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় বিদায়ী বছরের পুরো সেপ্টেম্বর জুড়ে রাজধানীর ১৬টি স্পটে সমাবেশ করে বিএনপি। ১০ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টন, ১১ সেপ্টেম্বর উত্তরা (পূর্ব জোন), ১২ সেপ্টেম্বর সেগুন বাগিচায়, ১৩ সেপ্টেম্বর উত্তরা (পশ্চিম জোন), ১৫ সেপ্টেম্বর পল্লবী, ১৬ সেপ্টেম্বর সূত্রাপুর, ১৮ সেপ্টেম্বর শ্যামপুর-কদমতলী, ১৯ সেপ্টেম্বর গুলশান, ২০ সেপ্টেম্বর বাসাবো বালুর মাঠ, ২১ সেপ্টেম্বর মীরপুর, ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রবাড়ি-ডেমরা, ২৩ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর, ২৪ সেপ্টেম্বর লালবাগ-চকবাজার-কামরাঙ্গীরচর, ২৫ সেপ্টেম্বর বাড্ডা, ২৬ সেপ্টেম্বর কলাবাগান এবং ২৭ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ে সমাবেশ করে বিএনপি।

এছাড়া ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে এক ঘণ্টা মৌন অবস্থান কর্মসূচি পালন করে দলটি। এ গুলোর মধ্যে চারটি সমাবেশে পুলিশ-বিএনপি-আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বেশ কিছু কর্মী আহত হন।

৬. প্রত্যক্ষ ভোটে ৩২ দিনে ৭০ কমিটি
‘ঢাকার নিস্ক্রিয় ভূমিকার কারণে আন্দোলন সফল হয়নি’— এই বদনাম ঘুচাতে আমান উল্লাহ আমান এবং আমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ৩২ দিনে ৭০টি ওয়ার্ডে নতুন কমিটি গঠন করে। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে ১ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত এই কর্মযজ্ঞ চলে। এই কমিটি গঠনের সুফলও পায় ঢাকা মহানগর বিএনপি। জ্বালানি তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এবং ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে দলের তিন কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর জুড়ে রাজধানীর ১৬টি স্পটে যে সমাবেশ হয়, সেখানে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন।

৭. ‘টুস করে ফেলে দিতে চাওয়ায়’ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান বর্জন
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে দাওয়াত দেয় সেতু বিভাগ। কিন্তু সেত উদ্বোধন অনুষ্ঠান দলীয়ভাবে বর্জন করে বিএনপি। কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলেন, ‘‘আমাদের নেত্রীকে যে সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেই সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমরা যেতে পারি না।’’

৮. মিডিয়া সেল গঠন
দলের নির্বাহী সদস্য জহির উদ্দিন স্বপনকে আহ্বায়ক এবং প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে সদস্য সচিব করে মিডিয়া সেল গঠন করে বিএনপি। মিডিয়া সেলের সদস্যরা হলেন— শাম্মী আক্তার, প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, কাদের গণি চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, আলী মাহমুদ (দিনকাল), আতিকুর রহমান রুমন এবং শায়রুল কবির খান। এই মিডিয়া সেল দেশব্যাপী সেমিনার করে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের’ রূপরেখা প্রস্তুতের জন্য মতামত গ্রহণ করে।

৯. দুর্নীতির ‘খতিয়ান’ দুদকে জমা
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত দুর্নীতির খবর বিশ্লেষণপূর্বক অভিযোগ আকারে তৈরি করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় বিএনপি। এ ব্যাপারে বিদায়ী বছরের ১১ এপ্রিল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও আপনারা (গণমাধ্যম) এই সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির খবর আপনাদের পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশ এবং প্রচার করছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত এসব দুর্নীতির খবরের ওপর ভিত্তি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো অ্যাকশনে যায়— এমনটি আমাদের চোখে পড়ে না। তাই একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত দুর্নীতির খবরগুলো যাচাই-বাছাই করে দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দেব।’

১০. মাদার অব ডেমোক্রেসি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত খালেদা জিয়া
গণতন্ত্র বিকাশে ‘অসামন্য অবদানের’ জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সন্মাননা দেয় কানাডীয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও)। বিদায়ী বছরের ৮ ফেব্রয়ারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, কানাডীয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গাইনাইজেশন (সিএইচআরআইও) গণতন্ত্র বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে। তিনি যে এখনো গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যে কারাবরণ করছেন, অসুস্থাবস্থায় গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন— এসব কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশনেত্রীকে এ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে। কানাডীয়ান হাই কমিশনও এখানে এটাকে এন্ড্রোস করেছে।’

১১. লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার
গত বছরে আলোচিত বিষয় ছিল লবিস্ট নিয়োগ। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল- প্রচুর টাকা খরচ করে বাংলাদেশবিরোধী ‘অপপ্রচার’ এবং বিদেশে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বিএনপি। আর বিএনপি বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। অবশেষে বিদায়ী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান— বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ নয়, উন্নয়ন সহযোগীদের (ডেভেলপমেন্ট পার্টার) চিঠি দিয়েছে তার দল। চিঠিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিচারহীনতার বিষয়গুলো রয়েছে।

ডেভেলপমেন্ট পার্টারদের কাছ থেকে কোনো রেসপনস পাওয়া গেছে কিনা?— এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘রেসপনস তো আপনারা দেখতেই পারছেন।’

১২. রোগব্যধিতে আড়ষ্ট খালেদা জিয়া
টানা ৮১ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১ ফেব্রুয়ারি রাতে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ ফেরেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, দাঁত, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। এর মধ্যেই গত বছর এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। বাসায় চিকিৎসা নিয়ে করোনা থেকে সেরে উঠলেও শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় গত বছর ২৭ এপ্রিল তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। বিদায়ী বছরে তার শারীরিক জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে বিদেশে যেতে পারেননি খালেদা জিয়া। অবেশেষে দেশীয় চিকিৎসায়-ই মোটামুটি সেরে ওঠেন তিনি।

১৩. মির্জা ফখরুলের কারাবাস
বিদায়ী বছরের ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে উত্তরার বাসা থেকে আটক হন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আটকের পর ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়- পল্টন সংঘর্ষের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডেকে আনা হয়েছে। অতঃপর ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পল্টন সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালান করে দেওয়া হয়। ওই দিনই আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর বেশ কয়েকবার জামিন আবেদন করলেও জামিন মেলেনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। তবে এটাই তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম কারাবাস নয়। এর আগে, সাত দফায় প্রায় পৌনে ৪ শ’ দিন কারাগারে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এবার অষ্টমবারের মতো কারারুদ্ধ হয়েছেন তিনি।

সারাবাংলা/এজেড/এমও

ইভিএম বিএনপি সালতামামি ২০২২

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর