সমিতি খুলে কোটি টাকা আত্মসাৎ, মামলা করেও মিলছে না আমানত
৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:২৯
ঢাকা: সমিতি খুলে সাধারণ গ্রাহকদের প্রলোভন দেখিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার সাভার উপজেলার আমিন বাজার এলাকায় ‘প্রীতি সমাজ কল্যাণ সমিতি’ এই প্রতারণা করে। ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ, এলাকায় সালিশ বিচার, জিডি এমনকি মামলা করার পরেও কোনো সুরাহা মিলছে না। উল্টো সাধারণ গ্রাহকদের ভয়ভীতি ও মারধর, এমনকি অনেককে এলাকা ছাড়াও হতে হয়েছে। যেকোনো মূল্যে তাদের কষ্টের জমানো টাকা ফেরত চান ভুক্তভোগীরা। এজন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।
অভিযুক্তরা হলেন— রাজু আহমেদ শ্যামল এবং তার সহযোগী ও ছোটভাই সুমন আহমেদ। এর মধ্যে শ্যামল টাকা আত্মসাতের মূলহোতা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এ ঘটনায় গত ২৬ ডিসেম্বর সাভারের আমিন বাজারের পশ্চিমপাড়া এলাকার ফাহিমা আক্তার ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। মামলায় শ্যামলকে প্রধান আসামি এবং সুমন ও সমিতির কয়েকজন মাঠকর্মীকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিরা হলেন— শ্যামলের আত্মীয় জেসমিন ও রেশমা। এছাড়াও দুই-তিনজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
এ মামলায় গ্রাহক সুমাইয়া আক্তার, আলেয়া বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস মিম, পারভিন আক্তার, কুলসুমা বেগম কুলসুম, সেলিম হোসেন, মো. গোলাপ ও সোহেল রানা রনিকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলায় ৪০৬/৪২০/৫০৬/১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি পিবিআইতে তদন্তাধীন রয়েছে।
মামলার বাদী ফাহিমা আক্তার শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) সারাবাংলাকে জানান, এর আগে টাকা চাইতে গেলে বিভিন্ন লোক দিয়ে ভয়ভীতি দেখান। শ্যামল তাকে বলেন, ‘টাকা দেওয়া হবে না। যেখানে পারিস যা। তোদের কোন বাপ টাকা তুলে দিতে পারে দিক।’ পরে টাকার তোলার বিচার চাইতে যান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি যে টাকা জমিয়েছিলেন, সেই জমা বইসহ চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দেন। কিন্তু শ্যামল ওই চেয়ারম্যানের সহকারী হওয়ায় কিছুই হয়নি। বরং শ্যামল ও তার লোকবল মিলে জমা বই ছিনিয়ে নেয়। এরপর তিনি সাভার থানায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আদালতে মামলা করেন।
ফাহিমা বলেন, ‘‘শুধু আমি নই, আমার মতো কয়েক হাজার গ্রাহক প্রীতি সমিতিতে টাকা জমিয়েছিলেন। কেউ দৈনিক ও কেউ মাসিক ভিত্তিক টাকা জমিয়েছিলেন। কেউ টাকা ফেরত পাননি। সাধারণ মানুষের জমানো এসব কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন শ্যামল। এখন টাকা চাইতে গেলে তারা নানারকম ভয়ভীতি দেখান। তারা বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি। থানা পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের কথায় চলে। চেয়ারম্যানও আমাদের। বেশি বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। এলাকায় থাকতে চাইলে ভালোভাবে থাকবি।’ অনেক সময় বাড়িতে সন্ত্রাসী কায়দায় লাঠিসোটা নিয়ে ছেলে-পেলে পাঠায়। টাকার জন্য মামলা করেছি জানি না আমরা টাকা পাবো কি না। সেজন্য আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।”
মামলার এজাহারে ফাহিমা আক্তার উল্লেখ করেছেন, প্রীতি সমাজ কল্যাণ সমিতি ও প্রীতি সমাজ কল্যাণ সঞ্চয় প্রকল্প নামে সমিতি চালু করে আমিন বাজার এলাকার নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষকে চিহ্নিত করে চটকদার ও লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে বাদী ও সাক্ষীরাসহ আরও নিরীহ লোকদের বিভিন্ন মেয়াদী অর্থ হাতিয়ে নেন রাজু আহমেদ শ্যামল ও তার সহযোগীরা। কোনোটির মেয়াদ ৫ বছর আবার কোনোটির মেয়াদ ১০ বছর ছিল। এরমধ্যে ফাহিমা আক্তারের দুই বই মিলে জমা হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা, ময়না বেগমের ৫টি বইয়ে জমা হয়েছিল ২৬ হাজার ৪৩০ টাকা, সুমাইয়া আক্তারের জমা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা, আলেয়া বেগম মাজুর জমা হয়েছিল ২০ হাজার টাকা, জান্নাতুল ফেরদৌস মিমের জমা হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা, পারভিন আক্তারের জমা হয়েছিল ৯ হাজার ১০০ টাকা, কুলসুমা বেগম কুলসুমের জমা হয়েছিল ৩১ হাজার ৫০০ টাকা ও সেলিম হোসেনের জমা হয়েছিল ২ হাজার ৪২০ টাকা। মামলায় মোট ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫০ টাকা আত্মসাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যেহেতু পাস বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার, সেই হিসেবে আত্মসাতের টাকার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা।
আরেক গ্রাহক সেলিম হোসেন বলেন, ‘শ্যামলের কাজই হচ্ছে বর্তমানে মাদক বেচাকেনা। নতুন কাউকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে তাকে পুলিশে দিয়ে ধরানো। আবার ওই আসামিকে ছাড়াতে পুলিশকে টাকা দেওয়ার নাম করে মোটা অংকের টাকা খসানো। এলাকায় কেউ বিদেশ থেকে আসলে তার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে টাকা আদায় করা। আবার কেউ নিজের জায়গাতেও বাড়ি করতে শুরু করলে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করা। টাকা না দিলে কেউ বাড়ি নির্মাণ কাজ করতে পারে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই মামলার আইনজীবী গোলাম রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফাহিমা আক্তার নামে একজন নারী গ্রাহক রাজু আহমেদ শ্যামলের নামে টাকা আত্মসাত করার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন। এই মামলাটির তদন্ত পিবিআইকে দিয়েছে আদালত।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার প্রধান আসামি রাজু আহমেদ শ্যামল বলেন, ‘ফাহিমা আক্তার নামে কোনো গ্রাহককে চিনি না। আর সমিতি আমি চালাইনি। আমি ছিলাম একজন পরিচালক। তাই কোনো গ্রাহককে আমার চেনার কথা নয়। আমার টাকা অনেকে মেরে চলে গেছে। কোনো গ্রাহক আমার কাছে আসলে তাদের টাকা দিয়ে দেই। ফাহিমা আমার কাছে কোনো দিনও আসেনি। আসলে টাকা দিয়ে দিতাম। আর মামলার বিষয়টা জানি না।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব ভুয়া অভিযোগ। আমি এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলাম। সামনে আবারও নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে। তাই অনেকে ঈর্শান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/এনএস