Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রশাসনে আলোচনা-সমালোচনার ২০২২

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৪৫

ঢাকা: বিদায় নিচ্ছে ২০২২ সাল। ২০২১ সালের মতোই ২০২২ সালের শুরুটা কেটেছে অনেকটা করোনার আবহে। সংক্রমণ বাড়তি থাকায় কিছুদিন বিধিনিষেধ থাকলেও তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে বছরজুড়েই প্রশাসন ছিল আলোচনা- সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাংবাদিকদের হুমকি, হয়রানি, খেলার পুরস্কার ভেঙে ফেলা, সহকর্মীকে মারধরের মতো ঘটনায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে মাঠ প্রশাসন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি বছর জুড়েই বিশাল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে অবসরে পাঠানোর ঘটনা যেমন কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা মহলে বির্তকও হয়েছে। অন্যদিকে পদ্মাসেতু চালু করে যে স্বস্তির ঢেঁকুর সরকার তুলেছিল, তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় জ্বালানি সংকটের কারণে। এসব নানা কারণে ২০২২ সাল ছিল আলোচনা-সমালোচনার বছর। ফিরে দেখা যাক প্রশাসনের ২০২২ কেমন ছিল।

বিজ্ঞাপন

দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর সরকারের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ান তখন সু- শাসন হুমকিতে পড়ে। ২০২২ সালে মাঠ পর্যায়ে এমন কিছু ঘটনা  সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বছরের মাঝামাঝি সময়ে আলীকদম উপজেলার ২ নম্বর চৈক্ষং ইউনিয়নের বেপারপাড়া এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আবাসিক স্বাধীন যুব সমাজের উদ্যোগে আন্তঃইউনিয়ন ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কারের জন্য রাখা ট্রফি ভেঙে ফেলেন সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। সেই ট্রফি ভেঙে ফেলার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। স্থানীয়দের ক্ষোভের মুখে ওই ইউএনওকে ঢাকায় বদলি করা হয়।

মধ্যরাতে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এক সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের ও তখনকার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর নাজিম উদ্দীনকে এক ধাপ পদাবনতি দেওয়া হয়। যদিও ওই শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিয়ে চলতি বছরের ৭ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে।

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও মোছাম্মৎ সাবিনা ইয়াসমিনকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় তিনি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে ‘মা’ বলে ডাকতে বলেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইয়ের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলায় পুলিশ দিয়ে ব্যবসায়ীকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল।

এলজিইডির চতুর্থ শ্রেনির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ইউএনওর বিরুদ্ধে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর উপজেলার সহকারী ভূমি কমিশনার (ভূমি) অমিত দত্ত নিজ অফিসের দুই কর্মচারীকে বেধড়ক মারধর করেছেন বলে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ যায়। সরকারি বাসভবনের প্রতিবেশী অন্য কর্মকর্তাদের হুমকি, মিথ্যা পরিচয়, খারাপ ব্যবহারসহ নানা অভিযোগে উপসচিক মো. লোকমান আহমেদকে শাস্তি দেওয়া হয়। তিন বছরের জন্য তার বেতন গ্রেড নিম্নতর ধাপে নামিয়ে দেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের এমন কর্মকাণ্ডে প্রশাসনকে বার বার বিতর্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এসকল কর্মকর্তাদের অপরাধের বিচারের আওতায় যে দফতর নিয়ে আসবে বা আসতে পারে খোদ সেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলাম বছরের সেরা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জ্ঞানের চর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়াতে প্রতিটি উপজেলায় লাইব্রেরির জন্য বই কেনার তালিকায় নিজেরই লেখা ২৯টি বই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ওই অতিরিক্ত সচিব। বিষয়টি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনার মুখে ১ হাজার ৪৭৭টি বই কেনার যে তালিকা করা হয় তা বাতিল করা হয়। পরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তা গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব।

সবচেয়ে বড় আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত। চাকরির মেয়াদ শেষ না হতেই গত অক্টোবর মাসে অবসরে পাঠানো হয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে। এরপর থেকে একদিকে যেমন আলোচনা- সমালোচনার ঝড় ওঠে তেমনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। যে আতঙ্ক এখনো কাটেনি।

একই আইনে তথ্য সচিবের পর সিআইডির মীর্জা আব্দুল্লাহেল বাকী, মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা, পুলিশ অধিদফতরের মো. শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির পুলিশ সুপার আলমীর আলম, ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপার মাহবুব হাকিম, আর্মড পুলিশ ব্যটেলিয়নের আলী হোসেন ফকির, পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান এবং সবশেষ গত ২০ ডিসেম্বর পুলিশ সুপার মো.মুনির হোসেনকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত শুধু পুলিশেরই আট কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। চাকরির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে অবসরে পাঠানোর কারণ প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকেনি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেন, চাকরির বয়স ২৫ বছর বয়স হলে যদি কারো কর্মদক্ষতার ঘাটতি দেখা যায়, দেশ প্রেমে কমতি দেখা যায়, তাহলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই তর্ক-বিতর্কের পাশাপাশি ব্যাপক রদবদল, পদোন্নতিও ছিল বছরজুড়ে। ২৩ জেলা প্রশাসককে বদলি করা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, জয়পুরহাট ও মাগুরা জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। গত এপ্রিলে ৯৪ জন কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জুনে ২৯ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। নভেম্বরে এসে ১৭৫ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ মাসেই সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ২৫৯ কর্মকর্তা, যা গত কয়েক বছরের চেয়ে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়।

আর চলতি মাসে অর্থাৎ বছরের শেষে এসে পরিবর্তন আনা হয় মন্ত্রিপরিষদ ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদের মতো শীর্ষ পদেও। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তার স্থানে পদোন্নতি দিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকে। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী একান্ত সচিব -১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।

এর বাইরে এবারই সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণা করা হয়। আর এ সাফল্যের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। এবার বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মাসেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পদ্মার পাড়ে সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে দেশি বিদেশি অতিথি, রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় পদ্মাপাড়। এছাড়া একই দিনে ১০০ মহাসড়ক ও ১০০ সেতুও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বছরের শেষে রাজধানী ঢাকায় উদ্বোধন করা হয় স্বপ্নের মেট্রোরেল।

এসব সাফল্যের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে জ্বালানি সংকট ছিল সরকারের জন্য বিব্রতকর। জ্বালানি সংকটে সরকার বাধ্য হয় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে। পরে লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিদ্যুৎ বিভাগ। ওই সময়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিস আদালতে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়। যদিও এখন সে পরিস্থিতি থেকে কিছুটা উত্তরণ হয়েছে। ওই পরিস্থিতির মধ্যে লিটারে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে আরও বিতর্কের সৃষ্টি করে। বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দামও।

গত চার অক্টোবর জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাটের কারণে দেশের অনেক এলাকা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে। এ নিয়েও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমালোচনা হয়েছে বিস্তর।

সারাবাংলা/জেআর/আইই

প্রশাসন ফিরে দেখা ২০২২

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর