Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোভিড-১৯ সংক্রমণ কম, নমুনা পরীক্ষা কমেছে তার চেয়েও বেশি

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:১৯

ঢাকা: ২০২১ সালের শেষভাগে দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন (বিএ.১ লিনেজ) প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই মূলত বাড়তে থাকে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বছরের সর্বোচ্চ ৯ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই লাখ ১৩ হাজার ২৯৪টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর থেকে কমতে থাকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা। তবে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা কমার চাইতেও বেশি কমেছে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৭৩ হাজার ৩৩৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় যা গেল বছরের সর্বনিম্ন।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার কমার সঙ্গে সংক্রমণের মাত্রা বোঝার কোনো সুযোগ আমাদের দেশে খুবই কম। তবে হ্যাঁ, পরিকল্পনা করে যদি বেশি নমুনা পরীক্ষা করা যায় সেক্ষেত্রে সংক্রমণের মাত্রা বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ণয়ে সুবিধা হয়ে থাকে।

২০২২ সালে কোভিড-১৯ পরিসংখ্যান

জানুয়ারি

২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা করা হয় জানুয়ারি মাসে। এই মাসে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরুর পরে এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা। এর আগে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দেশে সর্বোচ্চ ১১ লাখ ৮৭হাজার ৪৫১ টি ও জুলাই মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ লাখ ৩১ হাজার ৯৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

জানুয়ারি মাসে দেশে দুই লাখ ১৩ হাজার ২৯৪টি নমুনায় সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে এই আসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে ৩২২ জন মৃত্যুবরণ করেন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ১৫ শতাংশ।

ফেব্রুয়ারি

এই মাসে দেশে ৯ লাখ ২২ হাজার ৬৫৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে এক লাখ ৪৪ হাজার ৭৪৪টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ৬৪৩ জন যা আগের মাসের প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

মার্চ

এই মাসে দেশে চার লাখ ২২ হাজার ৬৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে আট হাজার নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ৮৫ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ১ দশমিক ০৬ শতাংশ।

এপ্রিল

এই মাসে দেশে এক লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে এক হাজার ১১৪টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল দশমিক ৬৭ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ৫ জন। সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় এই মাসে মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

মে

এই মাসে দেশে এক লাখ ৩২ হাজার ৫৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে ৮১৬ নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ০ দশমিক ৬২ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান চার জন। সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় এই মাসে মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

জুন

দেশে দুই লাখ ২৫ হাজার ৪৬৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় এই মাসে। এর মাঝে ২০ হাজার ২৭৮টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল আট দশমিক ৯৯ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ১৮ জন। সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় এই মাসে মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ০৯ শতাংশ।

জুলাই

এই মাসে দেশে দুই লাখ ৬০ হাজার ৬৫২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে ৩১ হাজার ৪৭২টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ১৪২ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

আগস্ট

দেশে এক লাখ ৪৩ হাজার ৮৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে ছয় হাজার ৬৮৯টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল চার দশমিক ৬৭ শতাংশ।

কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে এই মাসে মারা যান ৩২ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

সেপ্টেম্বর

এই মাসে দেশে এক লাখ ২৫ হাজার ৩৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে ১৩ হাজার ২৫১টি নমুনায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা যান ৪০ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৩০ শতাংশ।

অক্টোবর

দেশে এক লাখ ২৬ হাজার ৯২১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ১০ হাজার ৪৩টি নমুনায় এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল সাত দশমিক ৯১ শতাংশ।

কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে এই মাসে মারা যান ৬০ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল ০ দশমিক ৬০ শতাংশ।

নভেম্বর

৯৩ হাজার ৮৬১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় এই মাসে। এক হাজার ৩৪৫টি নমুনায় এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।

কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে এই মাসে মারা যান ১০ জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল এক দশমিক ৩০ শতাংশ।

ডিসেম্বর

এই মাসে ৭৩ হাজার ৩৩৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় যা গেল বছরের সর্বনিম্ম। সর্বনিম্ম ৫৪০টি নমুনায় এই মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ।

কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে এই মাসে মারা যান সাত জন। এই মাসে সংক্রমণ শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ছিল এক দশমিক ৩০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রথমত যদি বাস্তবে সংক্রমণ না থাকে তবে আমরা যতই নমুনা পরীক্ষা করি না কেন শনাক্তের হার বেশি নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ বেশি থাকে কিন্তু আমরা নমুনা পরীক্ষা কম করে থাকি তাহলেও আমরা প্রকৃত সংখ্যাটা পাব না। অর্থাৎ প্রকৃত যে সংক্রমণের সংখ্যা তার চাইতে আমরা কম পাব বাস্তবে। আবার পরীক্ষার সংখ্যা দেখেই কি শুধু লাভ হবে? এই যে নমুনা সেগুলো কাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে? কীভাবে করা হয়েছে? কে করেছে? এগুলোও কিন্তু ভাবনার বিষয় আছে।

তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে আমাদের যেভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তা কি কোভিড-১৯ উপসর্গ থাকার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে? এ সব ক্ষেত্রে দেখা যাবে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লেও পজিটিভিটির সংখ্যা তেমন হবে না। সুতরাং এই সংখ্যাগুলো দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। আমরা যদি কোনো কিছু গবেষণার জন্য করি অথবা সার্ভিলেন্সের মতো করে করি তখন আমাদের অনেক স্টান্ডার্ড মেইনটেন করতে হয়। সেই সময় আমরা প্রকৃত চিত্রের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারি। সেটি আমরা করতে পারছি কিনা বা করছি কিনা তাও ভাবনার বিষয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষা বেশি হলে সংক্রমণ শনাক্ত বেশি হবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি দেশে সংক্রমণের মাত্রা বেশি থাকে তবে কম নমুনা পরীক্ষাতেও সেটার প্রভাব বোঝা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে কিভাবে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বলা যায় দেশে কোনো কোনো স্থানে কিভাবে বা কোন প্রেক্ষাপটে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটিও বিবেচনায় নেওয়ার মতো বিষয়।’

ডা. বেনজির বলেন, ‘সাম্প্রতিক বিএফ.৭ বা নতুন যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের যে আলোচনা হয় সেটি স্বাভাবিক বিষয়। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। নতুন যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট বা সাব ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে আমরা যদি বেশি পরীক্ষা করতে পারি তবে সংক্রমণ শনাক্ত হতে পারে দ্রুত। যাদের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হবে তাদের দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা যেতে পারে বা আইসোলেশনে রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির পরিসংখ্যান অনেকটা কমে আসতে পারে।’

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এভাবে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাওয়াটা আসলে ঠিক না। আবার দেখা যাচ্ছে অনেকেই যদি উপসর্গ থাকার পরেও নমুনা পরীক্ষা না করায় তবে সেটাও ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ উপসর্গযুক্ত ব্যক্তি বা কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা কেউ যদি নমুনা পরীক্ষা করার পরে সংক্রমণ শনাক্ত হয় তবে দ্রুত আইসোলেশনে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে আসে।’

তিনি বলেন, ‘গত কয়েক মাস দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ অনেকটিই বলা যায় নিয়ন্ত্রণে। তবে যে কোনো ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক বিষয়। বিশেষ করে বিএফ. ৭ অনেক বেশি সংক্রামক। আর তাই নমুনা পরীক্ষা এখন বাড়াতে হবে। দেশের বিভিন্ন বন্দরে স্ক্রিনিংটাও জোরদার করে আইসোলেশনের সুবিধা বাড়াতে হবে। আর নাগরিকদেরও আসলে সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা প্রয়োজন। একইসঙ্গে ভ্যাকসিনেশনের দিকে জোর বাড়াতে হবে। বিশেষ করে যারা এখনো ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ শেষ করেনি তাদের সচেতন করে তুলতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে গেল বছরের জানুয়ারি মাসের পরে ডিসেম্বর পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা কমে আসার আরেকটি কারণ হতে পারে ভ্যাকসিনেশন। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কিন্তু আক্রান্তের হার কমে গেছে। একইসঙ্গে আক্রান্ত হলেও অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন খুব একটা বেশি হচ্ছে না। তবে আশা করব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে সেটি আবার বাড়বে। বিশেষ করে দেশের বন্দর এলাকাগুলোতে স্ক্রিনিং জোরদার করার পাশাপাশি যাদের মাঝে উপসর্গ দেখা যাবে তাদেরও দ্রুত নমুনা পরীক্ষার আওতায় আনা হবে।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

করোনা করোনাভাইরাস কোভিড-১৯

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর