গোছানো ঘর ‘তছনছ’ জাতীয় পার্টির, ছিল নানা আলোচনায়
৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:২৮
ঢাকা: বছরজুড়ে নানা আলোচনায় ছিল জাতীয় পার্টি (জাপা)। জি এম কাদের, রওশন এরশাদ ও বিদিশাকে ঘিরে আবর্তিত ছিল দলটির রাজনীতি। এছাড়া বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারে উত্তপ্ত ছিল দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পদ বাণিজ্যসহ অগ্রিম মনোনায়ন বাণিজ্য ছিল দলটির ‘টক অব দ্যা পার্ট’। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে অনেকটা গোছানো ঘর তছনছ হয়ে যায় দলটির। চেয়ারম্যান জি এম কাদের হয়ে যান ‘একঘরে’।
লণ্ডভণ্ড জাপায় দেবর-ভাবির পদ-পদবির লড়াই
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। একপর্যায়ে তা প্রকাশ্যেও আসে। হঠাৎ করেই রওশন অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকমাস দেশের বাইরে ছিলেন। এই সুযোগে দলে একক আধিপত্য বিস্তার করেন জি এম কাদের। কিন্তু রওশন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে জাপার লাগাম টেনে ধরেন। তিনি এখন জাপার চেয়ারম্যান হতে চাইছেন। কিন্তু এই পদ ছাড়তে রাজি নন বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের। বলতে গেলে লণ্ডভণ্ড জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবির পদ-পদবির লড়াই ছিল তুঙ্গে।
দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না জি এম কাদের
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিম্ন আদালতের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতে চলমান এ সংক্রান্ত আবেদন আগামী ৯ জানুয়ারির মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে নিম্ন আদালতে এ সংক্রান্ত মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বিদায়ী বছরের ১৪ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দিয়েছেন।
‘হ য ব র ল’ জাতীয় পার্টি
আন্তঃকোন্দলে ‘হ য ব র ল’ জাতীয় পার্টি। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পদ ও মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে দলটির এই অবস্থা বলে মনে করছেন জাতীয় পার্টির নেতা কর্মীরা। সঠিক নেতৃত্ব নেই। কার হাতে নেতৃত্ব যাবে— রওশন, জি এম কাদের নাকি দলে আসবে অন্য কেউ? তা নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক পাচ্ছে দলের মধ্যে। এই পরিস্থিতি দলের জনসমর্থন ও ভোট কমার আশঙ্কা করেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘নির্বাচনে লড়াই করার মতো একক ক্ষমতা নেই। জোটগতভাবে নির্বাচন করতে হলে দরকাষাকষি করে আসন বেশি ভাগিয়ে নেওয়ারও অবস্থা নেই দলটির। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেগম রওশন এরশাদের পৃথকভাবে কাউন্সিলের ডাক। এতে আসন্ন আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট ও আসনের সংখ্যা কমে যাবে।’
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, এরশাদের জীবদ্দশায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টিকে ‘ট্রাম কার্ড’ বলা হতো। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। কূটনৈতিক মহলে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটির গুরুত্বও কমে গেছে। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আমলে কূটনৈতিক মহলে জাপা আলোচনায় থাকত। এখন আর তা নেই।
ইশতেহার প্রণয়নে জাপার কমিটি
জাতীয় পার্টি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ণের উদ্যোগ নেয়। দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ইশতেহার প্রণয়নের জন্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভ রায়-কে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছেন।
কমিটির অপর চার সদস্য হলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব (রংপুর বিভাগ) ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন, ভাইস চেয়ারম্যান আহসান আদেলুর রহমান এমপি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. সাকিব রহমান।
রাঁঙ্গাকে বহিষ্কার
দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঁঙ্গাকে। পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। তিনি বলেছেন, তাকে যদি বাদ দিতেই হয় তবে নিয়ম অনুসারে দিতে হবে।
এরশাদ ট্রাস্টের নথি গায়েব
জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের লাইব্রেরিটি বর্তমানে এরশাদ ট্রাস্টের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরশাদ বেঁচে থাকতে লাইব্রেরিটি ট্রাস্টের কাজে ব্যবহারের জন্য লিখে দেন। ওই অফিসেই এরশাদ ট্রাস্টের দলিল দস্তাবেজ, রেজুলেশনসহ অন্যান্য নথিপত্র রাখা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেইসব নথিপত্র গায়েব হয়ে গেছে।
সে কারণে এবার এরশাদপুত্র এরিকের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েন এরশাদ ট্রাস্টের বোর্ড পরিচালকরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাস্টের সুবিধাভোগী এরিকের নিরাপত্তায় এবার আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা। যদিও এর আগে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
মায়ের হাত থেকে বাঁচতে এরিকের আকুতি
মা বিদিশা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ তুলে নিজেকে অবরুদ্ধ দশা থেকে উদ্ধার করতে সহায়তা চান এরশাদপুত্র এরিক এরশাদ। ৮ নভেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে পুলিশের সহযোগিতায় প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা থেকে বিদিশাকে বের করে দেওয়ারও অনুরোধ জানান এরশাদপুত্র।
মা বিদিশাকে ‘মীরজাফর’, খুনি এরশাদ শিকদারের সঙ্গে তুলনাও করেন এরিক এরশাদ। এরিক এরশাদ বলেন, ‘আমার বাঁচাটা জরুরি। আজকে তিনি (বিদিশা) যদি এই বাসায় থাকেন তাহলে আমি এই বাসায় থাকব না।’
জাপার নাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বিদিশাকে আহ্বান সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিককে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের নাম এবং পার্টির নাম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘রওশন এরশাদকে অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে তার অবর্তমানে বিদিশা নিজেকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, যা এক ধরনের প্রতারণা এবং বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের জন্য সম্মানহানিকর। এতে করে দেশজুড়ে পার্টির লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক এবং দেশবাসী বিভ্রান্ত ও বিক্ষুব্ধ।’
‘খেলার হুঁশিয়ারি’ বিদিশার
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মাঠে নেমেছেন তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি বেগম রওশন এরশাদের পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন সারাবাংলাকে।
বিদিশা বলেন, ‘আগামী তিন মাসের মধ্যে জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে বৈধ পন্থায় সরিয়ে দেওয়া হবে। এটিই জি এম কাদেরের প্রতি আমার আলটিমেটাম। কেননা জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছেন।’
এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনে টানাপোড়েন
২০২০ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিবসটি পালন করার জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। এমনকি এরশাদের সমাধিস্থালে দলটির চেয়ারম্যান যাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা।
কেন্দ্রীয় কমিটির একজন শীর্ষ নেতা এবং দলীয় এমপি নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এরশাদ মরে গেছেন, সে জন্য অনেকের ভাগ্য খুলেছে। তবে ক্ষতি হয়েছে দলটির। তিনি না মারা গেলে জি এম কাদের কোনোদিন দলের চেয়ারম্যান হতে পারতেন না। কেননা এরশাদের জীবদ্দশায় জি এম কাদেরের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক ছিল না।’
তবে জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয়ভাবে স্মরণসভা দোয়া, মিলাদ মাহফিল, প্রার্থনা সভা, এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন— দিবসটি পালন করার লক্ষ্যে দলটির কাকরাইল অফিসে বৈঠকে ঢাকার এমপি ও জাপা কো চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা রংপুরে এরশাদের সমাধিতে যাওয়ার প্রস্তাব করলেও দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু তাতে সায় দেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এরশাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সারাদেশে দুই লাখ পোস্টার ছাপানোর প্রস্তাব করা হলেও অর্থের অভাবে তা ছাপাতে পারেনি। দল থেকে মাত্র ২০ হাজার পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করা হয়।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এমও