Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তালেবানের জোড়া হুমকি: আফগানিস্তানে হামলা চালাতে পারে পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩২

আফগানিস্তানের ভুমিতে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর আস্তানায় হামলার ইঙ্গিত দিয়েছে পাকিস্তান। সম্প্রতি পাকিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) লাগাতার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। টিটিপি আফগানিস্তান ঘাঁটি থেকে সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানের ভূমিতে হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে ইসলামাবাদ।

গত সোমবার (২ জানুয়ারি) পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক-বেসামরিক নিরাপত্তা ফোরাম জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি) একটি বৈঠক করেছে। এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বরেও বৈঠক করেছিল এই কমিটি। টিটিপির অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে করণীয় ঠিক করতে এসব বৈঠক করেন পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতারা।

বিজ্ঞাপন

সভায় প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং নবনিযুক্ত সামরিক প্রধান জেনারেল মুনির উপস্থিত ছিলেন। এসব সভায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। সর্বশেষ সোমবারের সভায় অঙ্গীকার করা হয় যে, পাকিস্তানের জন্য হুমকি এমন জঙ্গিদের কোনো দেশকে লালন করতে দেওয়া হবে না। আফগানিস্তানের নাম না নিয়েই বিবৃতি প্রকাশ করে এনএসসি।

গত ৩০ ডিসেম্বর এনএসসি বৈঠকের পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এ ব্যাপারে খোলামেলা মন্তব্য করেন।  তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘কাবুলের তালেবান শাসকরা যদি পাকিস্তানি শাখাকে বিলুপ্ত না করে, তাহলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা টিটিপির উপর আক্রমণ চালাতে পারে পাকিস্তান।’ অর্থাৎ, আফগানিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে আফগান ভূমিতে সামরিক হামলার কথা বলেন তিনি।

প্রতিক্রিয়ায় তালেবান প্রশাসন সানাউল্লাহর মন্তব্যকে ‘উস্কানিমূলক’ বলে অভিহিত করে এবং আফগানিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকার করে।

বিজ্ঞাপন

গত ২ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে সশস্ত্র গোষ্ঠী পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে।’ বেসরকারি এক টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ বলেন, ‘আমরা আফগানিস্তান সরকারকে বলেছি, তাদের ভূমি আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।’

একই দিন এনএসসি বৈঠকের পর সরকারের তরফ থেকে জারি করা একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোনো দেশকে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠার অনুমতি দেওয়া হবে না। তাদের আক্রমণকে রাষ্ট্রের পূর্ণ শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা হবে।’

গত নভেম্বরে টিটিপির সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তি বাতিল করে ইসলামাবাদ। এর পর থেকে আগ্রাসী হয়ে উঠে সংগঠনটি। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তনে পাকিস্তানি শাখাটি উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে পাকিস্তানে ৩৬৭টি হামলা চালিয়েছে টিটিপি। প্রধানত পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে সামরিক, পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা এবং স্থাপনা টিটিপির লক্ষ্যবস্তু।

গত ১৮ ডিসেম্বর খাইবার পাখতুনখোয়ার বান্নু জেলায় একটি সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্র দখল করে জিম্মি করে টিটিপি। তিন দিন পর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায় ইসলামাবাদ। এর পরপরই ইসলামাবাদের একটি আবাসিক এলাকার কাছে গাড়ি বোঝাই বিস্ফোরক নিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় টিটিপি। এতে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়।

গত মঙ্গলবার পাঞ্জাব প্রদেশে দুইজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যা করে বন্দুকধারী। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটি টিটিপির কাজ।

সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদের এসব ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসলামাবাদে অবস্থিতি তাদের দূতাবাস কর্মী ও নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা জারি করছে।

গত বুধবার টিটিপি পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের উপর হামলার হুমকি দিয়েছে। স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরীফ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নাম উল্লেখ করেছে টিটিপি। এই দুজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করার জন্য টিটিপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বলে অভিযোগ সংগঠনটির।

একইদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের প্রতি ইসলামাবাদের শূন্য সহনশীলতা নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পাকিস্তানের জনগণ সন্ত্রাসী হামলার কারণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ থেকে আত্মরক্ষার অধিকার পাকিস্তানের আছে।’

কিছু বিশ্লেষক বলছেন, পাকিস্তান তার নিজস্ব রাজনৈতিক উত্থান এবং টিটিপির সঙ্গে সমঝোতায় ইচ্ছুক নীতির কারণে রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। এর ফলে দুর্ভাগ্যজনক যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইসলামাবাদ।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো আবদুল বাসিত বলেন, ‘পাকিস্তানের অদৃশ্য আফগান নীতি এবং টিটিপির সঙ্গে শান্তি আলোচনার ফলাফল হলো টিটিপি-র সন্ত্রাসী আক্রমণ বৃদ্ধি।’ ২০১৪ সালে টিটিপির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের দুর্বল করে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। এমন অবস্থায় টিটিপির সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসে পাকিস্তান সরকার। এতে দুর্বল টিটিপি শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়। পাকিস্তান তখন আশা করেছিল, তালেবানরা টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কিন্তু তা হয়নি।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, টিটিপি যোদ্ধারা আফগানিস্তানে বিদেশি জঙ্গিদের বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। টিটিপির সদস্য সংখ্যা ৩০০০ থেকে ৪০০০ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এদের মধ্যে অনেকেই তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর আফগান কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত।

এদিকে আফগান বাহিনী সম্প্রতি সীমান্তের কাছে পাকিস্তানি বেসামরিকদের উপর গুলি চালিয়েছে। এখন ইসলামাবাদ কার্যত জোড়া তালেবান সমস্যা মোকাবেলা করছে। একদিকে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা, অন্যদিকে পাকিস্তানে তালেবানি শাখার সন্ত্রাসবাদ।

টিটিপির বেশিরভাগ ঘাঁটি আফগানিস্তানে। পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে টিটিপির উপর হামলা করতে যায়, তাহলে কাবুলের সঙ্গে সংঘর্ষ হবে ইসলামাবাদের।

এ ব্যাপারে বাসিত বলেন, ‘ইসলামাবাদ-তালেবান সম্পর্ক আগামী সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান শুরু করা হয় তাহলে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে।’

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবেলায় পাকিস্তানের জন্য ওয়াশিংটনের সাহায্য অপরিহার্য।

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক সিনিয়র এক সন্ত্রাস দমন কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ‘পাকিস্তানের কাছে সন্ত্রাস দমন অভিযান এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য অর্থ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে, মার্কিন সহায়তা ছাড়া টিটিপির হুমকি মোকাবেলা করতে পারবে না পাকিস্তান।’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার পর থেকে ওয়াশিংটন এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সহযোগিতা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। গত এক মাস বা তারও বেশি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে মনে হচ্ছে সন্ত্রাস দমনে ইসলামাবাদকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক ওয়াশিংটন।

গত ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান তালেবান নেতা ক্বারি আমজাদকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা পাকিস্তানের জেনারেল মুনিরসহ শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পাকিস্তানে যান। চার মাসের মধ্যে এটি ছিল কুরিলার দ্বিতীয় পাকিস্তান সফর। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জেনারেল কুরিলা সীমান্ত নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করতে এবং আফগানিস্তানে সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আন্তঃসীমান্ত হুমকি নিয়ে আলোচনা করতে আফগান সীমান্তে গিয়েছিলেন।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাসিত এসব ব্যাপারে তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি পাকিস্তানকে তাদের পুরনো এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোকে যুদ্ধ উপযোগী করে তুলতে সাহায্য করেছে। এছাড়া সীমান্ত নিরাপত্তায় সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানের জন্য তহবিল বরাদ্দ করেছে।

তিনি বলেন, ‘এসব পদক্ষেপ টিটিপি এবং তালেবানের মধ্যে এই ধারণাকে শক্তিশালী করছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে টিটিপি ও আফগান তালেবান প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের উপর হামলা বাড়াতে পারে।’

সম্প্রতি টিটিপি বেশ সতর্ক হয়ে উঠেছে। সদস্যদের প্রতি জারি করা এক সতর্কবার্তায় টিটিপি নেতা মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সদস্যদের প্রতি এই সতর্কবার্তা পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টিটিপির উদ্বেগের ইঙ্গিত। সংগঠনটি আশঙ্কা করছে, আফগানিস্তানে টিটিপির শীর্ষ নেতাকে লক্ষ্য করে আমেরিকা ড্রোন হামলা চালাতে পারে।

-নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন

সারাবাংলা/আইই

আফগানিস্তান জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) টপ নিউজ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর