ঢাকা: ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৬ দিনে শীতজনিত দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন লাখ ৭৬ হাজার ২১ জন। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এই রোগীদের মধ্যে ৭৬ জন মারা গেছে। এর মাঝে ৭৫ জনই শিশু। রাজধানীর শিশু হাসপাতালে বছরের প্রথম ৯ দিনেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ছয় জন।
চলতি শীত মৌসুমে সরকারি হিসেবে মারা যাওয়া ৭৬ জনের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম বিভাগের। শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলাতেই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মারা গেছে ৩২ জন। এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলায় ২০ ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৬ জন মারা গেছে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে। গত ৫৬ দিনে দেশে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে মারা গেছেন ৭৩ জন যার শতকরা হার ৯৬ শতাংশ।
তবে এবারের শীত মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা নরসিংদী জেলায়। এই জেলায় পাঁচ হাজার ৫৫৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি টাঙ্গাইলে। এই জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫৭ হাজার ৮২১ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, এই দুই জেলায় কোনো মৃত্যুর খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিভিন্ন কারণে শীতজনিত বিভিন্ন রোগের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। আর এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে সচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে শিশু ও বয়স্কদের জন্য আলাদা যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা যত্ন নেওয়ার পরামর্শ তাদের। শীতের সঙ্গে অপুষ্টির কারণে শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টির দিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান কী বলছে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন হাজার ২২১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এই দুই রোগে আক্রান্তদের কেউ মারা যাননি বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্তের পরিসংখ্যান
সাধারণত শীত মৌসুমে শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এর মাঝে অন্যতম নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিস।
গত ২৪ ঘণ্টায় (৮ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি) শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৭৪ জন। এর মাঝে সর্বোচ্চ ৩০৮ জন ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২৮১ জন, খুলনা বিভাগে ১২০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০৪ জন, রংপুর বিভাগে ৯৪ জন, সিলেট বিভাগে ৭২ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫০ জন ও বরিশাল বিভাগে ৪৫ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১৪ জন রোগী শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন নরসিংদী জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে।
দেশে গত ৫৬ দিনে (১৪ নভেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি) শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৯ হাজার ৫৬ জন। এর মাঝে নবজাতকসহ মারা গেছেন ৭৩ জন শিশু।
শীতজনিত ডায়রিয়া আক্রান্তের পরিসংখ্যান
দেশে গত ৫৬ দিনে (১৪ নভেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি) ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন লাখ ২৬ হাজার ৯৬৫ জন। এর মাঝে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন তিন জন। এদের দুইজন শিশু ও একজন বৃদ্ধ।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ১৪৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ ৬৪৮ জন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়া ঢাকা বিভাগে ১৭৮ জন, খুলনা বিভাগে ২৯৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২০৯ জন, রংপুর বিভাগে ২৪৮ জন, সিলেট বিভাগে ১৭৫ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৬৪ জন ও বরিশাল বিভাগে ১২৯ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে।
শিশুদের যত্নে রাখার পরামর্শ
ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান বিপুল সারাবাংলাকে বলেন, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। নিউমোনিয়া, ঠাণ্ডা-কাশি জ্বর নিয়ে শিশুরা বহির্বিভাগে বেশি আসছে। সেই সঙ্গে রয়েছে শীতজনিত ডায়রিয়া।
তিনি বলেন, শীতের আগে বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগীদের যে সংখ্যা হতো শীতের এই সময়ে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে শিশুরা নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়া আক্রান্ত। অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুরাও আসছে। শীতে আবহাওয়া যেহেতু শুষ্ক এবং শহরে ধুলোর পরিমাণ বেড়ে যায়, তাই বাইরে বের হওয়া শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে অ্যাজমাতে।
তিনি বলেন, শীতজনিত ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা-কাশিতে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মাকে একটু বেশি সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে। সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুদের হালকা কুসুম গরম পানি খেতে দিতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি খাওয়াতে হবে। সেই সঙ্গে খেতে হবে রঙিন ফল।
ঠাণ্ডা-কাশি জ্বর হলে প্রচুর তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. রিজওয়ানুল আহসান বলেন, পাতলা আরামদায়ক পোশাক পরাতে হবে শিশুদের। আর নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকতে হবে, কারণ তারা খুব স্পর্শকাতর। ঠাণ্ডা যেন না লাগে, গরম কাপড় সব সময় গায়ে থাকলে অনেক সময় শিশুরা ঘেমে যায় এবং সেই ঠাণ্ডাটাও কিন্তু নিউমোনিয়ার অন্যতম কারণ। তাই শিশুদের পোশাক হতে হবে নরম এবং ঢোলা জাতীয়।
উষ্ণ আরামদায়ক কাপড়ের পাশাপাশি এ সময়ে শিশুদের মাস্ক পরাতে হবে এবং ধুলো এড়িয়ে চলতে হবে। তাইলেই এ সময়ের রোগবালাই থেকে দূরে থাকা যাবে বলে মন্তব্য করেন ডা. রিজওয়ানুল আহসান।
শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধরাও ঝুঁকিতে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউর) বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শীতজনিত রোগব্যাধি কিছুটা বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসের রেজিস্ট্যান্স কম থাকে। এ কারণে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, শিশু ও বয়স্কদের আবার নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া যাদের সিওপিডি, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগ রয়েছে তারাও শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। যাদের ডায়বেটিস, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ রয়েছে, তাদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। তারাও সর্দি, জ্বর ও কাশিসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হন।
পরিবেশ দূষণেরও প্রভাব পড়ছে
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শফি আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শীতজনিত বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আবহাওয়ার পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ুদূষণের কারণে শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাতমোজা, পা মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। সব সময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। তারপরেও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে না পারে, বুক স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ওঠানামা করে তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।