Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চিকিৎসক যখন ত্রাতা, মেট্রোরেলে চড়ে তখন ‘রাজত্ব’র আগমন

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১২ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:৫৯

ঢাকা: রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নবজাতক বিশেষ পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ‘রাজত্ব সাহা’। মাত্র ১১ ঘণ্টা আগেই পৃথিবীতে আগমন তার।

‘রাজত্বকে’ গর্ভে নিয়েই চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তির জন্য রওয়ানা দেন সোনিয়া রায়। স্বামী সুকান্ত সাহাসহ যখন মেট্রোরেলে তাদের যাত্রা শুরু হয় তখনও তারা বুঝতে পারেননি কী অপেক্ষা করছে আর খানিক পরেই। আশেপাশে থাকা যাত্রীদের কাউকেই চিনতেন না তারা।

বিজ্ঞাপন

মায়ের গর্ভে থাকাকালীন শেষ সময়গুলোতে ‘রাজত্ব’ জানতে পারে পৃথিবীটা সুন্দর। সেই ক্ষণগুলোতে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার দূত হিসেবে এগিয়ে আসেন ডা. ফেরদৌসীসহ আরও কয়েকজন। অথচ গন্তব্যস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে যখন মেট্রোরেলের যাত্রী হিসেবে তারা আগারগাঁওয়ের পথে রওনা দেন তখনও একে অপরকে চিনতেন না তারা।

ডা. ফেরদৌসী অন্যান্য দিনের মতোই গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য মেট্রোরেলে উঠে বসেছিলেন। এরপরেই দেখতে পান সামনে থাকা এক নারী (সোনিয়া রায়) প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। তার স্বামী সুকান্ত সাহা স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে যান। মেট্রোরেল থেকে নামলেই একটা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ফোন দিয়ে তাই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স স্টেশনে গেইটে পাঠানোর অনুরোধ করছিলেন।

এমন অবস্থায় এগিয়ে আসেন রাজধানীর সরকারি এক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পেডিয়াট্রিক সার্জন ডা. ফেরদৌসী। সোনিয়ার স্বামীর কাছে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান। হাতের কাছে কোনো কিছু না থাকলেও প্রাথমিকভাবে সোনিয়া রায়কে সাহস দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় এগিয়ে আসেন অন্যান্যরাও।

বিজ্ঞাপন

সুকান্ত সাহা মুহূর্তগুলোর কথা জানিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, “আমি টেনশনে অবশ হয়ে যাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম মেট্রোতে কিভাবে ডাক্তার পাব? ঠিক সেই সময়েই ডা. ফেরদৌসী এসে অভয় দেন। একজন চিকিৎসক আছেন এটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পাই। অন্যান্যরাও তখন এগিয়ে আসেন। তার পরেই তো এলো ‘রাজত্ব’।”

ডা. ফেরদৌসী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মানুষের সেবা দেওয়া। আমি সেটাই করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে গেলে এমন কিছু ঘটবে তা মেট্রোরেলে চড়ার আগে কখনো ভাবিওনি।’

তিনি বলেন, ‘আমি কেবিনে ওঠার পরে দেখলাম একজন নারী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। তার অনেক কষ্ট হচ্ছিল, যা সবাই বুঝতে পারছিল। আমি যেহেতু একজন চিকিৎসক তাই নিজেই এগিয়ে যাই। তখন ওই নারীর স্বামী আমাকে জানান হাসপাতালে ভর্তির জন্য যাচ্ছেন তারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রসব বেদনার কষ্ট আসলে কেউ মুখে বলে বোঝাতে পারবে না। আমি যেহেতু চিকিৎসক তাই বুঝছিলাম। কাকতালীয়ভাবে আমি একজন পেডিয়াট্রিক সার্জন। আর এরপরের বিষয়গুলোতো সবাই জেনেই গেছেন।’

ডা. ফেরদৌসী বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে আমাদের সঠিক সময়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। সেই হিসেবেই আমি যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথেই দায়িত্ব শুরু হয়ে যাবে তা কখনো ভাবিনি। শুধু ভাবলাম একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার দায়িত্ব যেকোনো পরিস্থিতিতেই পালন করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সড়কপথে যাওয়ার সময় যদি এই প্রসব বেদনা উঠতো তখন আসলে কি হতো তা বলতে পারছি না। আরেকটা বিষয় হলো রাস্তায় যানজট থাকলে সেখানে অ্যাম্বুলেন্স সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারে না। রাস্তার ধুলাবালির কথা আলাদাভাবে নাই বলি। আজ মেট্রোরেলের ফার্স্টএইডের কক্ষে যে অবস্থায় সন্তান প্রসব করানো হলো তা সড়কপথে সম্ভব নাও হতে পারতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা যেকোনো পরিস্থিতিতেই সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। আমরা এটা আমাদের কোর্স শুরুর আগেই শপথ নিয়ে থাকি। সেই দায়িত্বটাই আমি পালন করেছি। এখন সন্তান ও মা দু’জনেই সুস্থ আছেন— এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।’

মেট্রোরেলের একই কেবিনে ছিলেন সালমা আঁখি নামে একজন যাত্রী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বগিতে হঠাৎ এক নারীর চিৎকার শুনতে পাই। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি এক নারী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একজন চিকিৎসকও এগিয়ে আসেন। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে সাহায্য করে যান সেই নারীকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর পর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তার পরেই স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়। এবং তা বড় ধরনের কোনো জটিলতা ছাড়াই। পুরো বিষয়টা নিয়ে আমরা আসলে সবাই একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কারণ, প্রসববেদনার কষ্ট ও তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসককে পাওয়াটা আসলে সৃষ্টিকর্তার উপহার। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু ব্যবস্থা করার জন্য।’

নবজাতক ‘রাজত্ব’র বাবা সুকান্ত সাহা বলেন, ‘দু’দিন আগেও ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর ফলোআপে যাই। উত্তরা বিমানবন্দর এলাকায় রাস্তার কাজ চলার কারণে মেট্রোতেই যাই আমরা। চিকিৎসক আজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।’

তিনি বলেন, ‘আজ উত্তরা-বিমানবন্দর মহাসড়কে যানজট থাকার কারণে মেট্রোরেলেই হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দিই। পরিকল্পনা ছিল আগারগাঁও থেকে ধানমন্ডি চলে যাব। মেট্রোস্টেশনে লিফট থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি চলাচলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু মেট্রোরেল চালুর পরই ওর প্রসব বেদনা ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম কিছু মানুষ ছুটে এলেন। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ফার্স্ট এইড সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই সন্তানের জন্ম হয়। স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হওয়ায় কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে।’

এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে তখন তার পাশেই বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে পর্যবেক্ষণে ‘রাজত্ব’ সাহা। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই যার মেট্রোরেল চড়ে যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে পৃথিবীর আলো দেখার আগ পর্যন্ত সে দেখে নতুন অতিথি হিসেবে তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য কিছু পরোপকারী মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

পৃথিবীতে এসে কান্নার সঙ্গে নিজের আগমনের সংবাদ পৌঁছে দেয় সবার কাছে। আশেপাশেই তখন ছিল মেট্রোরেলের ভেতর দায়িত্ব পালন করা রোভার স্কাউট ও প্রাথমিক প্রতিবিধানকারীরা। সঙ্গে ছিলেন ডা. ফেরদৌসী ও সালমা আঁখিরা।

রাজত্ব সাহার বাবা সুকান্ত বলেন, ‘আমি আসলে সবাইকে কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবো বুঝে উঠতে পারছি না। প্রসব বেদনার সঙ্গে সঙ্গে যারা ছুটে এলো, আর ফার্স্ট এইড সেন্টারে যেভাবে স্কাউট ভাইবোনেরা সাহায্য করল- তাদের সবার প্রতি আসলে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই।’

তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষই আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করে দেয়। সব মিলিয়ে বলব, সৃষ্টিকর্তা আমার সন্তানের জন্মদানের জন্য কিছু দেবদূত পাঠিয়েছিলেন। আমাদের পরিবারের সবাই সেইসব দেবদূতদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

তিনি আরও বলেন, “আমার বড় সন্তানের নাম রাজবী সাহা। আর নতুন অতিথির নাম ষষ্ঠীর তিথি দেখে পারিবারিকভাবে রাখা হবে। তবে আজ যা কিছু হলো ও যেভাবে হলো তাতে বলতেই হয় আমার সন্তান পৃথিবীতে এলো পরোপকারী মানুষদের সাহায্যে। সেও যেন ভবিষ্যতে একজন পরোপকারী ও ভালো মানুষ হিসেবে সবার মনে ‘রাজত্ব’ করতে পারে সেই দোয়া ও আশীর্বাদ করবেন।”

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

চিকিৎসক রাজত্ব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর