সূর্য সেনের ফাঁসি দিবস: বিপ্লবীদের জাতীয়ভাবে স্মরণের দাবি
১২ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ফাঁসি দিবসে অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে জন্মভূমি চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিপ্লবীকে শ্রদ্ধা জানানোর সময় মাস্টারদার স্মৃতিজড়িত স্থান সংরক্ষণ ও গৌরবজনক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সকালে নগরীর জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংগঠকরা।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের সময় উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, নগর মহিলা লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর নিলু নাগ, রুমকি সেনগুপ্ত, আঞ্জুমান আরা, তছলিমা বেগম রুবি, নারীনেত্রী নন্দিতা দাশগুপ্ত।
সমবেতদের উদ্দেশে কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী উপমন্ত্রীর একটি বার্তা পড়েন। বার্তায় নওফেল বলেন, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনসহ বহুবিধ বিপ্লবের অগ্রনায়ক ছিলেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে যেমন সুনাম ছিল তেমনি দেশের মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা, চরিত্রের বলিষ্ঠতায় ক্রমে আকর্ষণীয় করতো তরুণদের। ক্লাসের ছাত্রদের বলতেন দেশের দুরবস্থার কথা, দেশপ্রেমের কথা, স্বাধীনতার কথা। সূর্য সেন গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের জমি তৈরি করছিলেন। আজও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে মাস্টারদাকে স্মরণ করে আমরা এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। তিনি বাঙালির বিপ্লবের ধ্রুবতারা।’
শ্রদ্ধা জানানোর পর দ্য চিটাগাং অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা সূর্য সেনসহ সব বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং জাতীয়ভাবে এসব বিপ্লবীদের স্মরণানুষ্ঠান করার দাবি জানান। একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, সংগঠনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক রনজিৎ কুমার দে, সহ-সাধারণ সম্পাদক সমরেশ বৈদ্য কোষাধ্যক্ষ বিবেকানন্দ আচার্য, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি দীপংকর চৌধুরী কাজল, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ছিলেন।
পুষ্পস্তবক দিয়ে বিপ্লবী সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অশোক সাহা, ফরিদুল ইসলাম, অজয় সেন ও অমিতাভ সেন। এ সময় অশোক সাহা বলেন, ‘মাস্টারদা ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে জীবন দিয়ে দেশবাসীর মনে স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহা সৃষ্টি করেছিলেন। সূর্যসেনের সংস্পর্শে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের মতো সংগ্রামী নারী চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি দেশবাসীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারে।’
চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়নের পক্ষে সভাপতি শাহ আলম ,সহ-সভাপতি প্রীতম দাশ, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশিদুল সামির, কোষাধ্যক্ষ অভিজিৎ বড়ুয়া, ক্রীড়া সম্পাদক মিঠুন বিশ্বাস, সদস্য ইনতেখাব সুমন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন জেলা সভাপতি ইমরান চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শুভ দেবনাথ, কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান আরিফ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক তানভীর ইলাহী, শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক তাহলীল আবসার অর্ণব ও সদস্য অরিত্র ভট্টাচার্য।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত জালালাবাদ পাহাড়ে এখনো কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। যুব বিদ্রোহের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সোনালী অতীত এখনো অজানা। সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে এই ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাসদ (মার্কসবাদী) জেলা সদস্য সচিব শফিউদ্দিন কবির আবিদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য সোমা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের রিপা মজুমদার,পুষ্পিতা নাথ ও আবদুল্লাহ জাওয়াদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
চট্টগ্রাম কারাগারে সূর্য সেনের সঙ্গে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির মঞ্চেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে ‘বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ’। সংগঠনের সভাপতি অঞ্জন কান্তি চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক সিঞ্চন ভৌমিক, চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার এমরান হোসেন মিয়া, ডেপুটি জেলার মনির হোসেন এ সময় বক্তব্য দেন।
জেএম সেন হলে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আনোয়ার পলাশ ও মায়মুন উদ্দীন মামুনের নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন।
মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি দিবসে বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগর শাখা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বক্তারা এ দাবি জানান। এ সময় সংগঠনের পক্ষে আমিরুল ইসলাম শাহানূর, মোহাম্মদ দেলোয়ার, তহিদুল ইসলাম মিথুন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম, কনিক বড়ুয়া, জাহিদ হাসান সাইমুন, মোস্তফা আমান, শুভ দত্ত, মো. রুবেল, ইলমাইল সাকিব, অন্তর তানভির, তহিদুল করিম ইমন, গোবিন্দ দত্ত, জাহেদ অভি, আবিদুল ইসলাম, ফয়সাল মাহমুদ জয়, মিনহাজুল ইসলাম, মুশফিকুর রহমান মিশু, জাবের আহমেদ, বোরহান, ইরফানুল হক রেজা, আব্বাস উদ্দীন ছিলেন।
উল্লেখ্য, সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির (বিপ্লবীদের গঠিত সংগঠন) চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। মাস্টাররদা সেখানেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর তিনি পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। সূর্য সেনকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে।
সরকার ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার শুরু করে। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘটনার পর মাস্টারদা পটিয়ার গৈড়লা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ধরা পড়েন। সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়াারি চট্টগ্রাম কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি/পিটিএম