দেশের ৫৯ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এক্সরে হয় না
২৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৩৮
ঢাকা: দেশের ৫৯ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের এক্সরে করা হয় না। কিছু উপজেলায় এক্সরে যন্ত্র নেই— আবার থাকলেও তা নষ্ট হওয়ায় ব্যবহার করা হয় না। জেলা পর্যায়েও প্রায় ১১ শতাংশ হাসপাতালে এক্সরে করা হয় না। আর তাই রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচালনার জন্য জরুরি সব ধরনের শূন্য পদ পূরণের সুপারিশ জানানো হয়েছে এক গবেষণা প্রতিবেদনে।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিকস বিভাগের এপিডেমিওলজি শাখা থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য জানা গেছে।
‘বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ’— শীর্ষক গবেষণাটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে শেষ করা হয়েছে।
গবেষণাটি করেন বিএসএমএমইউ পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান ও তার সহযোগী দল।
২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৯টি জেলা হাসপাতাল ও ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
এতে জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভে চেকলিস্টের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ৭৭ জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, সুপারিনটেনডেন্ট ও মেডিকেল অফিসার, আবাসিক মেডিকেল অফিসারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথা পর্যালোচনা করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যথাক্রমে শতকরা ৮৮.৯ এবং ৪১.২ ভাগ ক্ষেত্রে এক্সরে পরিষেবা পাওয়া গেছে।
গবেষণা প্রতিবেদন বিষয়ে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের বড় সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দেওয়ার সময় চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ বা সমস্যার মুখোমুখি হন, যা স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দেয়।’
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশের বেশিরভাগ সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভরশীল। এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। যা সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অন্তরায়। এ চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা গেলে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি কমিয়ে উন্নত সেবা দেওয়ার পরিবেশ তৈরি সম্ভব।
শতকরা ৭৭.৮ ভাগ জেলা হাসপাতালে এবং শতকরা ৬৪.৭ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নারী রোগীদের, অ্যাটেনডেন্টদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি— উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
এতে জানানো হয়, দেশের শতভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ডরমেটরি, কোয়ার্টার সুবিধা থাকলেও জেলা হাসপাতালে এর উপস্থিতি শতভাগ ৪৪.৪ ভাগ। শতকরা ৫২.৯ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ব্যবহার উপযোগী ডরমিটরি, শতকরা ১৭.৬ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য থাকা ডরমিটরি ও কোয়ার্টারে গার্ড থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, অনুমোদিত পদের বিপরীতে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে শতভাগ ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র-সিনিয়র কনসালটেন্ট শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিকেল অফিসার, সহকারী সার্জন পদ শূন্য রয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, নার্সিং স্টাফ-মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে শতভাগ ১৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ২৫ ভাগ পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৪২ ভাগ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ান পদ শূন্য।
এ ছাড়া জেলা হাসপাতালে শতকরা ২০ ভাগ ক্লিনার পদ শূন্য থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য ক্লিনার পদের পরিমাণ শত ৬৬ ভাগ— এমন চিত্র উঠে আসে গবেষণার প্রতিবেদনে।
এছাড়াও রাজনৈতিক নেতাদের অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ ও প্রভাব, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কিছু গণমাধ্যমকর্মীর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ চিকিৎসকদের সেবা দানে বাধা সৃষ্টি করে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
তবে জনবল সঙ্কটের কথা স্বীকার করলেও দেশের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনার জন্য সেসব প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ও সিভিল সার্জনদের দুষছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানপ্রধান ভালো হলে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী, দুই তৃতীয়াংশ হাসপাতালের এক্সরেসহ সব মেশিনপত্র নষ্ট। এগুলোর দায় সিভিল সার্জন এবং ইউএইচএফপিওদের নিতে হবে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি যদি ফাংশনাল না থাকে তাহলে তার কাজটা কী? বেশিরভাগ রোগী পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন বাইরে করে?’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিভাগ নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমাদের সবার সম্মিলিত ইচ্ছা থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও ভালো এবং পরিবর্তন করতে পারি। এই পরিবর্তন আমাদেরই করতে হবে। অন্যকেউ এসে পরিবর্তন করবে না। চিকিৎসকরা যেন জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে থাকেন সেজন্য যা যা করা প্রয়োজন, আমরা পর্যায়ক্রমে সেটা করে দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও