বইমেলার আঁতুড় ঘরে কারা?
২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৫২
ঢাকা: অমর একুশে বইমেলার যাত্রা কবে, কখন, কীভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে এর জন্ম— সে ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। সেদিক থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণকে বইমেলার আঁতুড় ঘর বলা যায়।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মেলার এই ‘আঁতুড় ঘরটা’ তার স্বাতন্ত্র্যবৈশিষ্ট্য বা কৌলিন্য হারিয়েছে। বইমেলার আঁতুড়ঘরখ্যাত বাংলা একাডেমির আঙিনা জুড়ে এখন আর বইয়ের স্টল-প্যাভিলিয়ন দেখা যায় না। আর্থিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠান, মিশন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজপোর্টাল, ক্রীড়া সংগঠন, বড়লোকদের ক্লাব এমনকি দেশিয় শিল্পগ্রুপের বিশেষ পণ্য প্রদর্শনে স্টল-প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মূলত, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সোহওয়ার্দী উদ্যানে পাঠানোর পর মেলার আঁতুর ঘরটা হাতছাড়া হয়ে যায়। দশ বছরের মাথায় এসে এবার রীতিমতো তা অন্যের দখলে। এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে ১১১টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬০টির অধিক স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটি হচ্ছে প্রকাশনা সংস্থা। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বই প্রকাশনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। এগুলোর কাজের ধরন ‘অমর একুশে বাইমেলার’ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থান পাওয়া সাতটি প্রকাশনীর মধ্যে রয়েছে ধানসিঁড়ি প্রকাশনী, যার স্টল নম্বর ৮৮৯; প্রপা প্রকাশনী, যার স্টল নম্বর ৮১৪; মুক্তধারা, যার স্টল নম্বর ৭২৬; মুক্তধারা নিউইয়র্ক, যার স্টল নম্বর ৮৪৯-৮৫০; বীকন পাবলিকেশন্স, যার স্টল নম্বর ৭৯১; উন্মাদ পাবলিকেশন্স, যার স্টল নম্বর ৮৮৬; ইবিএস বইঘর, যার স্টল নম্বর ৮৫৩-৮৫৪।
অপরদিকে প্রকশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও অমর একুশে বইমেলার ‘আঁতুড় ঘরে’ যেসব প্রতিষ্ঠান ঢুকে পড়েছে, সেগুলো হলো— অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন (৭৪২), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (৭৮৬), আকাশ (৮৬২), আঞ্জুমান-এ রহমানিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট (৭৪১), আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন (৭৪০), আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (৮২৭), আমরা ক’জন মুজিব সেনা (৮২৪), ইন্টারন্যাশনাল অটিজম ফাউন্ডেশন (৭৫৯), ইসকন (৮০৭), ইসলামিক ফাউন্ডেশন (৮৯৮-৮৯৯), উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (৮১৫), ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী (৮৫৫), এটুআই (৮৩৭-৮৩৮-৮৩৯), এসএমই ফাউন্ডেশন (৭৩০), ওয়ান্ডারসফট সলিউশন (৮০৪), কবি নজরুল ইনস্টিটিউট (৭৬৯-৭৭০-৭৭১), কর্নেল তাহের সংসদ (৮১৬), চড়ুই ডটকম (৭৫৯), চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর (৮৯০-৮৯১), চাইল্ড অ্যান্ড মাদার কেয়ার (৭৫০), চায়না রেডিও (৭৪৫-৭৪৬), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (৭৭৯-৭৮০), জয় বাংলা আর্ট গ্যালারি (৮১০), জয়বাংলা একাডেমি (৮৮৫), জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যেজোট (৮৬০-৮৬১), জয়ীতা (৮২৮-৮২৯-৮৩০) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর (৮৪৭-৮৪৮), জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র (৭৫১-৭৫২-৭৫৩) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (৮৮৩)।
এছাড়া জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) শিক্ষা মন্ত্রণালয় (৭৫৪), জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (৮৬৭-৮৬৮), টুরিস্ট পুলিশ বাংলাদেশ (৮২১), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) (৮০৮), ঢাকা টাইমস (৭৩৫), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা (৭৮১-৭৮২), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (৮১৯-৮২০), ঢাকা রিপোর্টার্স (৭৩২), তথ্য অধিদফতর (৭৭৬), দি এ্যাপারেল নিউজ (৮১১), নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশন (৮১২), পদক্ষেপ নিউজ ডটকম (৭৩৬), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) ৭৩১, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর (৭৬০-৭৬১), প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র (৭৩৯), প্রেস ইনস্টিটিউ বাংলাদেশ (৭৭২-৭৭৩), ফোরনেটশা বাংলাদেশ লি. (৮৫৬-৮৫৭), বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ আন্তর্জাতিক পর্ষদ (৮০৩), বঙ্গবন্ধু পরিষদ (৮২৫-৮২৬), বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন (৮৫১-৮৫২), বঙ্গবন্ধু বইমেলা পরিষদ (৮৭৭-৮৭৮), বঙ্গবন্ধু বার্তা (৭৯৪), বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ (৮০২), বনলতা সাহিত্য পরিষদ (৭৯২), বর্ণ আইটি (৮১৭), বসুন্ধরা পেপার মিলস লি. (৭৪৮-৭৪৯), বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ (৮৩৪-৮৩৫-৮৩৬) এবং বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগও (৮৩১-৮৩২-৮৩৩) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্টল পেয়েছে।
একাডেমিতে স্টল পাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরও আছে— বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজি (বিআইএসএস) (৭৪৩-৭৪৪), বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) (৮৯২-৮৯৩), বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (৭৬৪-৭৬৫), বাংলাদেশ কবি সংগঠন (৭৫৬), বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস (০), বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (৮৬৫-৮৬৬), বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি (৭২৭), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (৮৯৬-৮৯৭), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (৮২২-৮২৩), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (৭৬৬-৭৬৭), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) (৮৭৬), বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অধিদফতর (৭৮৪-৭৮৫), বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ (৭৭৪-৭৭৫), বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (৭৮৯), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প পরিষদ(বিসিএস আইআর) ৭৭৭-৭৭৮, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (৮৭৯-৮৮০), বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব (৭৬৮), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) (৭৪৭), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ (৭৯০) এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (৭৬২-৭৬৩)।
এছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমি (৯০০-৯০১-৯০২-৯০৩), বাডস (৮০৫), বায়ান্ন থেকে একাত্তর (৮৫৮-৮৫৯), বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন (৮০৯), বিবি ফাউন্ডেশন (৮০১), বিশ্বভরা প্রাণ (৮৪০), মাইক্রোটেক ইন্টারেটিভ (৭৩৪), মাইক্রোস ডিজিটাল (৮৮৪), মাতৃভূমি (৮৬৩-৮৬৪), মানস (মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা) (৮৭৫), মাস্তুল ফাউন্ডেশন (৭৩৮), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (৮৯৪-৮৯৫), মুঠোবই (ই-বুক) ৭৩৭, রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) ৮৭৪, রূপকল্প (৭৫৭), র্যাভেন সিস্টেম লি. (৮১৮), শুনবই (৭৫৫), শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ (৮৮১) শ্রী শ্রী অনুকুলচন্দ্র সৎসঙ্গ (৮০৬), সৎসঙ্গ বাংলাদেশ (৭৩৩), সমবায় অধিদফতর (৮৬৯-৮৭০), সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার (৭২৮-৭২৯), সিআরআই (৮৪৫-৮৪৬), সিএ চার্টার্ড একাউন্টস (৮৭১-৮৭২), সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ৭৮৮, সেন্টার ফর লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ (৭৮৭) স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা (৮৮৭-৮৮৮) বরাবরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ তথা বইমেলার আঁতুড় ঘরে ঢুকে পড়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে বইমেলার লক্ষ্য উদ্দেশ্য কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারণের বছরই। তখন কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং সাংবিদকদের একটি অংশ জোরের সঙ্গে বলার চেষ্টা করেছে- আর্থিক, বাণিজ্যিক, এনজিও, দেশি-বিদেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্টল বরাদ্দ না দিলেই বইয়ের প্রকাশনী সংস্থাগুলোকে অনায়াসে জায়গা দেওয়া সম্ভব। এতে করে একাডেমির সঙ্গে বইমেলার নাড়ির সম্পর্ক অটুট থাকবে, বাড়বে আবেদনও।
কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এবং চাহিদা পূরণে কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিকদের এই শুভ চিন্তাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। বরং বইমেলার আঁতুর ঘর থেকে বইয়ের পসরা সরিয়ে সেখানে স্থান করে দেওয়া হয়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে, যাদের সঙ্গে বই এবং বইমেলার সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
জানতে চাইলে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে. এম. মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত পাচঁ/সাত বছর ধরে বইমেলার মূল ভেন্যু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ওই পাশেই সব। এখন কোনো প্রকাশনী সংস্থাকে একাডেমি প্রাঙ্গণে স্টল দিলে তারা নেবে না। সে কারণেই এদিকটাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল-প্যাভিলিয়ন রাখা হয়। এটা নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম