ভুল চিকিৎসায় জর্ডান নাগরিকের মৃত্যুর অভিযোগ ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে
৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:৩২
ঢাকা: রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ইউসুফ হাসান আল হেনদি (বিদেশি নাগরিক) নামে গালফ এয়ারের এক পাইলটের মৃত্যুর অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছে পরিবার।
ইউসুফের মৃত্যুর প্রায় দেড় মাস পর জর্ডান থেকে ঢাকায় এসে সোমবার (৩০ জানুয়ারি) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ তোলেন তার বোন তালা এলহেনদি।
সংবাদ সম্মেলনে তালা এলহেনদি বলেন, ‘আমি একজন মার্কিন নাগরিক। কাজ করি ব্রিটিশ সরকারের হয়ে। আমার ভাইয়ের চিকিৎসায় ভুল ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পেতে আমি বাংলাদেশে এসেছি।’
তালা এলহেনদির ভাষ্যে সেদিনের ঘটনা
২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার মেরিডিয়ান হোটেলে ছিলেন ইউসুফ হাসান আল হেনদি। গালফ এয়ারের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইউসুফ হাসান ভোর সাড়ে ৩টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি ইমিগ্রেশনের সামনে জ্ঞান হারান।
এলহেনদি বলেন, ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমার ভাইয়ের প্রথম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তখন তিনি পাঁচ মিনিট কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) পেয়েছেন। ভোর সাড়ে ৫টায় তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।’
ইউনাইটেড হাসপাতালে ইউসুফকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি দাবি করে তালা এলহেনদি বলেন, ‘ভোর পৌনে ৬টায় তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে দ্বিতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এরপর তাকে ১০ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। রিটার্ন অব স্পনটেইনাস সার্কুলেশন (আরওএসসি) ও ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রামের (এসিজি) পর রিপোর্টে দেখা গেছে, তার একটি অংশ ফুলে গেছে। সকাল পৌনে ৭টায় তার তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং আরওএসসির সঙ্গে ১৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয়। বেলা সোয়া ১১টায় ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমের মধ্যেই আমার ভাইয়ের চতুর্থ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাকে ৪৫ মিনিট সিপিআর দেওয়া হয় এবং টেম্পোরারি পেসমেকার (টিপিএম) বসানো হয়। দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে আমার ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’
তালা এলহেনদি বলেন, ‘চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সময় তাকে ওষুধ প্রয়োগে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করেছেন ডা. কায়সার নাসির। কিন্তু আমার ভাইয়ের পরিবারের কাছে চিকিৎসার যে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তাতে তার নাম পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘ফোনে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। ভোর ৪টা ৮ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত আট ঘণ্টা সময় পেয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে তারা আমার ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইমার্জেন্সি রুমের দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানতেন যে, এক ঘণ্টারও বেশি সময় আগে আমার ভাইয়ের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে এবং তার রক্তচাপ কমে যাওয়ায় সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন। কিন্তু তারা কোনো কার্ডিওলজিস্টকে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেখানে কোনো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। শ্বাসনালী সুরক্ষার জন্য আমার ভাইকে টিউব পরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইমার্জেন্সি রুমের কর্মকর্তারা। কোনো কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ ছাড়াই ১৫ মিনিটের মধ্যে আমার ভাইকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।’
অবহেলা ও কার্ডিওলজিস্টের অনুপস্থিত দাবি
তালা এলহেনদি বলেন, ‘কাগজপত্রের কোথাও লেখা নেই যে, সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন। আমি যখন হাসপাতালের কাছে মেডিকেল ফাইল চাই তারা সেটি আমাকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় মেডিকেল ফাইল আমার ভাইয়ের মেয়েকে দেওয়া হয়েছে, যা সত্য নয়।’
কার্ডিওলজিস্টের অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত পরামর্শ ছিল দাবি করে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, কার্ডিওলজিস্টের মতামত নেওয়া হয়েছে। অথচ করোনারি কেয়ার ইউনিটে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তাহলে কিভাবে তার পরামর্শ নেওয়া হলো এবং রোগী সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণাই বা কী ছিল। দাবি করা হচ্ছে, কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্ট বেছে নিয়েছেন কার্ডিওলজিস্ট, যার পরিচয় অজ্ঞাত। কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চিকিৎসক আমার ভাইকে হেপারিন সোডিয়াম ৫০০০ আইইউ ইনজেকশন দিয়েছেন। রক্ত জমাট বাঁধা বন্ধ করতে এটা দেওয়া হয়। এতে আরও পরিষ্কার যে, রোগীর চিকিৎসায় সেখানে কোনো কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন না। কাজেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাদে সাধারণ কর্মীদের পরামর্শে ছিল চরম অবহেলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমার ভাইকে ক্যাথ ল্যাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, সিএজি পরীক্ষা শেষ করার পর আমার ভাইয়ের বাঁ পাশের প্রধান ধমনী ৯৯ শতাংশ ব্লকড পাওয়া যায়। কিন্তু জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রতিটি বিষয়ে চিকিৎসকেরা কেন বিলম্ব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়। তারা নিজেরাও স্বীকার করেছেন যে, রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল নয়। শেষ মুহূর্তে এসে ধমনীতে ৯৯ শতাংশ ব্লক পাওয়া গেছে, যা আরও আগে পাওয়া যেত।’
ওই নারাী বলেন, ‘মেডিকেলের কাগজপত্র বলছে, আমার ভাইয়ের আগে অ্যাজমা ও উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস আছে। কিন্তু তার আসলে এমন কিছু ছিল না। দাবি করা হচ্ছে, এই দুই রোগ তার অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে ও চিকিৎসা কঠিন করে দিয়েছে। ভিত্তিহীনভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের কাছে আমার ভাইয়ের উচ্চরক্তচাপের ওষুধ ও ইনহেলার দেওয়া হয়েছে। যে কারণে তাদের মনে হয়েছে, আমার ভাই এই দুই রোগে আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকেরা আমার ভাইয়ের চিকিৎসার ইতিহাস জানতেন না, এমনকি গালফ এয়ার কিংবা পরিবারের কাছ থেকেও এমন কিছু জানার চেষ্টাও তাদের ছিল না।’
তালা এলহেনদি বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ ও হাসপাতালের কাগজপত্রে কারসাজি করা হয়েছে। আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে আমি চিকিৎসার কাগজপত্র ও সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রমাণাদি কারসাজি করতে তারা এসব দিতে তিন দিন সময় নিয়েছে। আমার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা হয়েছে। আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলায় তারা আমাকে বিস্তারিত কাগজপত্র দিয়েছেন।’
তালা এলহেনদি এসব অভিযোগের বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক রিলেশন অফিসার আরিফুর রহমান জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে।
কোনো পদক্ষেপ নেয়নি গালফ এয়ার
ইউসুফ হাসান আল হেনদি যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলেন সেই গালফ এয়ারের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ তুলেছেন তালা এলহেনদি। তিনি বলেন, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর আমার ভাই অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই অবস্থাতেই ছিলেন। তিনি গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ওঠার সময় এটা হয়েছে। তিনি এই ফ্লাইটের একজন পাইলট ছিলেন। নিজের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কাজেই গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল তিনি যাতে সঠিক চিকিৎসা পান তা নিশ্চিত করা। এছাড়া গালফ এয়ারের কাছে থাকা আমার ভাইয়ের অতীতের চিকিৎসার ইতিহাস ইউনাইটেড হাসপাতালে জমা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেননি।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম