এরশাদকে নিয়ে মন্তব্য: সংসদে হট্টগোল, স্পিকারের রুলিং
৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:৫৮
ঢাকা: জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে সংসদের অধিবেশনে হট্টগোল হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে লালমনিরহাট-১ আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের এমন বক্তব্যে প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির এমপিরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় সংসদে হৈ চৈ ও চিৎকার-চেচামেচি শুরু হয়। এর সূত্র ধরে সংসদে কিছু সময়ের জন্য অচল অবস্থা চলে। এ সময় সংসদে সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার সামসুল হক টুকু কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরে তাৎক্ষণিক সভাপতির চেয়ারে এসে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এক পর্যায় তিনি উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে তা পর্যবেক্ষণ করে এক্সপাঞ্জের রুলিং দেন।
সোমবার (৩০ জানুয়ারি) সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষনের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জন্য ফ্লোর পান মোতাহার হোসেন। মোতাহার হোসেন বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘আমাকে ছয়বার সংসদ এবং দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। প্রথমবার ৫৫ হাজার ভোটে জিতেছি। গতবার জিতেছি ২ লাখ ৫৫ হাজার ভোটে। গত ২০১৪ সালের আমার স্ট্রং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উনি মাত্র ৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। উনার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল হাতিবান্ধা-পাটগ্রামে। আরও একবার আমি সংসদ সদস্য হতে পারতাম। আগের দিন আমি জিতেছি ২৭’শ ভোটে। পরেরদিন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাকে ২২’শ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। ফলে গতবার আমার এলাকার ভোটাররা উনাকে জানিয়ে দিয়েছেন তার অবস্থাটা কী।’
মোতাহার হোসেনের বক্তব্যের শুরুতে জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে ছিলেন না। তবে তার বক্তব্যের আট মিনিটের মাথায় ফিরোজ রশীদ দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় মোতাহার হোসেন থেমে যান। কিছুক্ষণ পর সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার তাকে বসতে বলেন এবং পরে চাইলে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেবেন বলে জানান। তবে তাতে তিনি নিবৃত না হলে মাইক ছাড়াই কথা অব্যাহত রাখেন। এ সময় সংসদে চিৎকার চেচামেচি শোনা যায়।
এ সময় মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আপনি সিনিয়র সংসদ সদস্য। আমার সময়ে আরেকজন বক্তৃতা দেবেন কীভাবে?’ এ সময় স্পিকার মোতাহার হোসেনের মাইকও বন্ধ করে দেন। ওই সময় মোতাহার হোসেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে কাজী ফিরোজ রশীদকে এক মিনিটের জন্য ফ্লোর দেন। তিনি এক মিনিটের মতো কথা বলেন। পরে তার মাইকও বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
এ সময় ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘যদি কোন বক্তব্য থাকে আপনি পরে সময় নিয়ে বলবেন।’ ঠিক এ সময় বিরোধী দলের চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ দাড়িয়ে মাইক ছাড়াই কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় ডেপুটি স্পিকার মোতাহার হোসেনকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, ‘আমি রাঙ্গাঁ সাহেবকে একটু শুনি।’
রাঙ্গাঁ ফ্লোর পেলে সরকারি দলের সদস্যরা চিৎকার চেচামেচি শুরু করেন। তিনি ফ্লোর নিয়েই বলেন, ‘চলে যাবো। চিৎকার আর দরকার নেই, আমরা চলে যাব।’ পরে তিনি এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত ইস্যুর ব্যাখ্যা দেন। এক পর্যায়ে তার মাইক বন্ধ হয়ে যায়। পরে ডেপুটি স্পিকার তাকে বসতে বলেন। জাতীয় পার্টির এমপিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলবেন। সময় দেওয়া হবে। আপনি বসুন। তার (মোতাহার হোসেন) বক্তব্য শেষ হোক। তবে ডেপুটি স্পিকারের কথায় কর্ণপাত না করে জাতীয় পার্টি এমপিরা চিৎকারর করতে থাকেন। এ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘আপত্তিকর কিছু থাকলে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে। আর পয়েন্ট অব অর্ডারে অন্য সুযোগে আপনি কথা বলবেন। আপনারা বসেন আমি পয়েন্ট অব অর্ডারে সুযোগ দেব।’
মোতাহার হোসেনের উদ্দেশে ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘আপনি এজেন্ডার ওপরে কথা বলবেন। এমন কথা বলবেন না যাতে সংসদ পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটে।’ এরপর তার বক্তব্য শেষ করার জন্য ফ্লোর দেন। ঠিক এই সময়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তড়িগড়ি করে হাউজে প্রবেশ করে সভাপতির আসনে বসেন। এর আগে প্রায় ১০ মিনিটে মতো সংসদে অচলবস্থার সৃষ্টি হয়।
স্পিকার হাউজে ঢুকে সবাইকে বসতে বলেন। বিরোধী দলের কাজী ফিরোজ রশীদ ও মসিউর রহমানের রাঙ্গাঁর নাম উল্লেখ করে বসতে বলেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘হাউজের একটি ডেকোরাম আছে। এখানে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা হচ্ছে। এখানে একজন বক্তা তার বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা আপনারা উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু এজন্য আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। উনি (মোতাহার) উনার বক্তব্য শেষ করবেন। আপনারা হাত তুলবেন। যদি এমন কোন বিষয় থাকে যেটা এক্সপাঞ্জে করার প্রয়োজনীয়তা আছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ আছে।’
এ সময় মোতাহার হোসেনকে দেওয়া ১০ মিনিট শেষ হলে স্পিকার তাতে আরও ১/২ মিনিট কথা বলার জন্য ফ্লোর দেন। ফ্লোর পেয়ে তিনি এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত বিষয়ে আবারও বলেন, ‘১৯৮৫ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। সেবারও উনাদের ক্যান্ডিডেটের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। নব্বইয়ে আমি ফের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াই। তখনও উনাদের ক্যান্ডিডেটের জামানত আমি বাজেয়াপ্ত করি। এবং শেষবার ভোটেও। ঢাকা এয়ারপোর্টে আমাকে এরশাদ সাহেবই বলেছিলেন, তুমি আমার জামানত বাজেয়াপ্ত করে দিলে। আমি বলেছিলাম আগেও দু’বার করেছি। এবারও করলাম। আমি তো এখানে অসত্য, মিথ্যা কথা বলিনি।’
এরপর মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেন স্পিকার। তিনি বলেন, ‘আমরা মাগরিবের নামাজের পর বাইরে ছিলাম। ওখান থেকে শুনলাম উনি বলছিলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত করে আমি এই সংসদে এসেছি।’
লালমনিরহাট-১ আসনে এরশাদের মনোনয়ন জমা দেয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাকে এরশাদ সাহেব বললেন, তুমি লালমনিরহাটে গিয়ে আমারটা (মনোনয়নপত্র) সাবমিট করে দিয়ে আস। আমি সাবমিট করতে গিয়ে দেখলাম উনার (মোতাহার) লোকজন সব। আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তবুও আমি জমা দিই।’
এ সময় স্পিকার জানতে চান তিনি কোন সালের কথা বলেছেন? জবাবে রাঙ্গাঁ বলেন, ‘এটা ২০১৪ সালের ঘটনা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পরাজিত করে উনি সংসদে এসেছেন এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আপনি এটা এক্সপাঞ্চ করে দেবেন।’
পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি আমাদের মাঝে নেই। একজন মৃত ব্যক্তির নামে এ ধরনের কুৎসা রটনা উচিত নয়। মোতাহার সাহেবের ভালো করে জানা উচিত এরশাদ সাহেব রংপুরের মাটিতে কোনো দিনও হারেননি। তিনি কারাগারে থেকে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেছেন। ২২টি আসনে একা প্রার্থী হলে সবগুলোতে জয়ী হতেন। তিনি কারাগারে থেকে দুইবার পাঁচটি করে আসনে জয়ী হয়েছেন।’
মোতাহার হোসেনের উদ্দেশে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘উনি এত বড় বীর বিক্রম হয়ে গেল? এরশাদ সাহেবের জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। যে নির্বাচনে এরশাদ সাহেব দাঁড়ায়ইনি। তারা কোনো প্রার্থীকে দাঁড়াতেই দেননি। আমাকে দিয়ে উইড্রো করালেন। পরে দামি দাঁড়িয়েছি। এটা সম্পূর্ণ এক্সপাঞ্জ চাই। আমাদের দাবি এটা এক্সপাঞ্জ করবেন। না হলে রংপুরের মাটিতে তার অসুবিধা হবে।’
পরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ ইস্যুতে রুলিং দেন। তিনি বলেন ‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ জনাব মোতাহার হোসেনের বক্তব্যে যদি কোন তথ্যগত ত্রুটি থাকে থেকে থাকে তাহলে সেটা বিবেচনা করে তা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এক্সপাঞ্জের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম