‘ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং’ প্রযুক্তির ছোঁয়াযুক্ত সবুজ কারখানা
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৫৬
ঢাকা: সুয়িং মেশিন। তার উপরে ছোট্ট একটি মনিটর। তাতে ভেসে উঠছে শ্রমিকের নাম। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কতোটুকু কাজ শেষ করেছেন দেখা যাচ্ছে তাও। একইভাবে ফ্লোরে রাখা বড় মনিটরেই দেখা যাচ্ছে কোন লাইনে কাজের অগ্রগতি কতোটুকু, কোন শ্রমিকের কী সমস্যা! এখন এমনসব প্রযুক্তির দেখা মিলছে দেশের বেশ কিছু তৈরি পোশাক কারখানায়। তেমনই একটি সবুজ কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) সাভারের বাইপাইলের ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড। সম্প্রতি টিম গ্রুপের এই তৈরি পোশাক কারখানাটি ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০২২ সালের শুরুতে সবুজ কারখানার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। এটি একটি প্লাটিনাম ক্যাটাগরির সবুজ কারখানা। প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার স্কয়ার ফিটের উপর অবস্থতি কারখানাটিতে তিনটি ভবন রয়েছে। এরমধ্যে ৬ তলার মূল ভবনে চলে পোশাক তৈরির কাজ। অন্য একটি ভবনের পুরোটাই ওয়ার হাউজ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাইরেও ডে কেয়ার সেন্টার, হেলথ সেন্টার ও ফেয়ার প্রাইজ শপ রয়েছে এই কারখানাটিতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানাটির মূল ভবনের দেওয়ালে সবুজ ঘাষ। দুই ভবনের মাঝে খোলা মাঠে সবুজের সমারোহ। কারখানার ভেতরে চোখে পড়বে দেশি বিদেশি নানা প্রজাতির গাছ। ডে কেয়ার সেন্টার ও হেলথ সেন্টারের কাঠামোটিও সবুজে ঘেরা। মূল ভবনের দেওয়ালে প্রতিষ্ঠানটির লগোর নিচেই চোখে পড়বে সবুজ কারখানার তালিকাভূক্ত হওয়ার মনোগ্রাম। কারখানাটির চর্তুদিকই সবুজে ঘেরা। যেন সবুজে ঘেরা এক তৈরি পোশাক কারাখানা!
মূল ভবনের ছাদে রয়েছে সোলার প্যানেল। ভবনটির পুরো ছাদটিই ব্যবহৃত হচ্ছে সৈর বিদ্যুৎ তৈরিতে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, সোলার প্যানেল থেকে ৩০০ কিলো ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা দিয়ে কারখানার বিদ্যুতের চাহিদার ২৫ ভাগ মেটানো সম্ভব হয়। সাপ্তাহিক ছুটি ও ঈদের ছুটিতে কারখানার বন্ধ থাকলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকারি গ্রিডে যুক্ত হয়। সরকারি গ্রিডে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ যুক্ত হয়, প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ বিল থেকে তা বাদ দেওয়া হয়। এতে ওই প্রতিষ্ঠান ও সরকার উভয়েই উপকৃত হচ্ছে বলে কর্মকর্তাদের ভাষ্য। এছাড়া এই কারখানাটিতে পানির পুনঃব্যবহারও হয়ে থাকে।
কারখানাটি ঘুরে দেখা গেছে, বাইরের পরিবেশের মতোই প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের পরিবেশও চমকপ্রদ। নেই কোনো গিঞ্জি পরিবেশ। রয়েছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। প্রতিষ্ঠানটির একটি ফ্লোরে দেখা গেল, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (কিউএমএস) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি এমন একটি সফটওয়্যার যার মাধ্যমে কখন কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তা নির্ণয় করা যায়। কোন লাইনে কী সমস্যা ওই ফ্লোরের একটি বড় মনিটরে তা ভেসে উঠছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, কিএমএস সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত খরচ কমে এসেছে। এখন এখানে যে কাজ চলছে, তার কোন কিছুই হিডেন থাকছে। আজকের কি সমস্যা আমার সামনে এখনই তা চিহ্নত হয়ে গেছে। ম্যানুয়াল্লির ক্ষেত্রে আগে যেটা হতো কোথায় কি সমস্যা তা রিপোর্ট করতে হতো। এখন আর তা করা লাগছেনা। এরফলে খরচ যেমন কমেছে তেমনি উৎপাদন সক্ষমতাও বেড়েছে।
এদিকে একই ফ্লোরে আইওটি ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে দেখা গেছেম, সুইয়িং মেশিনের উপরে একটি মনিটর। ওই মনিটরে কর্মীর নাম ভাসমান রয়েছে। শ্রমিক যে মডেলের কাজ করছেন সেই মডেলের নামও ভাসছে। কতোটুকু কাজ করতে হবে সেই লক্ষ্যমাত্রা যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি কতোটুকু কাজ করেছেন তাও দেখা যাচ্ছে। ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, এই প্রযুক্তির ফলে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা বাড়ছে। ইচ্ছে করে কোন শ্রমিক কাজে ফাঁকি দিচ্ছে না।
কারখানাটিতে কাজ করে শ্রমিকরাও বেশ সন্তুষ্ট। আশুলিয়ার কাইচাবাড়ির রবিউল ইসলাম। ফোর এতে কাজ করছেন দুই বছর ধরে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এখানে ডিসিপ্লেন খুবই ভালো। ১ তারিখে বেতন পাই। অফিসের সঙ্গেই ডাচ বাংলার বুথ আছে। সেখান থেকেই টাকা উঠাতে পারি। ফ্যাক্টরিতে ট্রেড ইউয়িনও রয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তারা কাজ করেন।
প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করেন খুলনার তানসুরা বেগম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এখানে চার মাস ধরে কাজ করছি। কারখানাটিতে কাজের পরিবেশ খুব ভালো। এখানে সুবিধাও বেশি। আগের ফ্যাক্টরিতে অনেক নাইট ডিউটি থাকতো। এখানে তেমন নাইট ডিউটি নেই। এখানে কেউ বকাঝকা করেনা। কোন কাজে ভুল হলে সুপারভাইজাররা সমাধান করে দেন। ১ তারিখ ব্যাংকে বেতন হয়।
দিনাজপুরের লিপু নামের আরেক শ্রমিক বলেন, কারখানার পরিবেশ খুবই সুন্দর। নিয়ম কানুন ভালো। কম দামে আমরা ফ্যাক্টরির দোকান থেকে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিতে পারি। বাচ্চাদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টর রয়েছে। মেয়েলি সমস্যা হলেও ছুটি মেলে। সব মিলিয়ে এই কারখানায় কাজ করলে মনে হয় নিজের বাড়িতেউ কাজ করছি।
ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রুগ্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড কিনে নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গেল বছর সবুজ কারখানা হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।’
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, টিম গ্রুপে ৫৩ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী কাজ করেন, এই কারখানাটিতে ৪০ জন কাজ করছেন। টিম গ্রুপ ২০২৩ সালের মধ্যে ২ লাখ বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন কারখানা ও তার আশেপাশে বৃক্ষরোপণের কাজ চলছে।
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই কারখানাটি কেবলমাত্র গ্রিন নয়, এখানে সবার আচার আচরণও সবুজ। কারণ গ্রিন ফ্যাক্টরির সব কিছুই গ্রিন হওয়া উচিৎ। গ্রিন ফ্যাক্টরি তৈরি করা একটি দায়িত্ব। আমি পরিবেশ দূষণ করব কী করব না- এটি কিন্তু আমার একান্ত নিজস্ব দায়িত্ব। গ্রিন ফ্যাক্টরির সঙ্গে আমি মনে করি না কোনো প্রাইজের সম্পর্ক আছে। তবে এটুকু বলব দায়িত্ব শুধু একা আমার নয়। এখানে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ অতিরিক্ত খরচ হয়েছে, তার জন্য কিন্তু দাম বেশি পাওয়া যায় না।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৫ শতাংশ। ২০২৬ সালের মধ্যে আমাদের ১ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। মন্দা ও যুদ্ধ কেটে গেল আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে আশা করি।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ওভারটাইম দুই মাস ধরে বন্ধ। এটা শুধু আমার ফ্যাক্টিরিতে নয়, অনেক ফ্যাক্টরিতেই একই অবস্থা। ইপিবি বলছে রফতানি বেড়েছে। আসলে কতোটুকু বেড়েছে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে হয়ত কাজ আরও বাড়তে পারে।’
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, হেলথ সেন্টারে ১৫ টি বেড রয়েছে। সার্বক্ষণিক দুজন ডাক্তার এতে কর্মরত থাকেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স ও মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গর্ভবতী শ্রমিকদের আলাদা যত্ন নেওয়া হয়। ২০২১ সালে ২৩৯ জন নারী শ্রমিক গর্ভাবস্থায় ছিলেন। তাদের অতিরিক্ত ৩০ মিনিট বিরতি দেওয়া হয়। ওই বিরতির সময়ে ডিম ও দুধ জাতীয় ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করা হয়। ওইসব খাবার তাদেরকেই খেতে হয়, কারণ তা ফ্যাক্টরির বাইরে নেওয়া যায় না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে একটি ফেয়ার প্রাইজড শপ রয়েছে। সেখান থেকে শ্রমিকরা ক্রেডিট বেসিসে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থাৎ নগদ অর্থ ছাড়াই পণ্য ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে শ্রমিকদের জন্যে। এছাড়া বাজার মূল্য থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ কম দামে শ্রমিকরা ফেয়ার প্রাইজ শপ থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেন। কারণ এসব পণ্য বিভিন্ন কোম্পানি থেকে মিলগেট রেটে ক্রয় করা হয়ে থাকে। আর ফেয়ার প্রাইজ শপ পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটিকে মাসে মাত্র লাখ টাকার মতো খরচ করতে হয়।
প্রসঙ্গত, ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড টিম গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এই কারখানাটিতে মূলত জ্যাকেট তৈরি হয়। টিম গ্রুপের অধীনে ৬ টি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটিই সবুজ কারখানার তালিকাভূক্ত। তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানটির পোশাকের নিজস্ব ব্রান্ডও রয়েছে। ‘টুয়েলভ ক্লথিং লিমিটেড’ নামের ব্রান্ডটির ৩৬ টি আউটলেট রয়েছে দেশে। একইসঙ্গে টিম গ্রুপ ওষুধ, তথ্য প্রযুক্তি ও আবাসন ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে।
এদিকে, সবুজ কারখানার তালিকায় দীর্ঘদিন রয়েই শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এখন সবুজ কারখানা ১৮৬ টি। এছাড়া গ্রিন ফ্যাক্টরির তকমা পেতে প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ৫৫০টির বেশি কারখানা। সবুজ কারখানার তালিকায় বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে