অর্ধশতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থীর স্কেচে পুরান ঢাকার চালচিত্র
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:১৭
ঢাকা: চারশ বছর আগে মোঘল আমলে সুবা বাংলার রাজধানী হয় ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এই নগরীর চারপাশে আরও তিনটি বড় নদী থাকলেও ঢাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে মিশে আছে বুড়িগঙ্গা। আর সেই বুড়গঙ্গা ঘিরে গড়ে ওঠা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খোঁজে ঢাকায় আসা অর্ধ শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থীর চিত্রকর্ম নিয়ে ঢাকায় শুরু হয়েছে দুই সপ্তাহের এক চিত্র প্রদর্শনী।
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সবার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীটি প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সম্পর্কে চিন্তা ও কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে প্রকল্পটি অনুসরণ করে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
‘পুরান ঢাকা থেকে শিক্ষা: বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পেশার নগরায়ন’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী এবং কর্মশালার উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। উদ্বোধনী দিনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি, বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত মাহি মুদুপুই এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স থিজ উডস্ট্রাসহ অনেকে।
ফজলে নূর তাপস ঢাকায় বিদেশী শিক্ষার্থীদের স্বাগতম জানিয়ে তাদেরকে ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখার ও ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি তাদেরকে লালবাগ কেল্লা, রুপলাল হাউজ, কার্জন হল, আহসান মঞ্জিল, শহিদ মিনার, রোজ গার্ডেন, বড় কাটরা, ছোট কাটরার মত ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখার আহ্বান জানান। এসময় ফুচকাকে বিশ্বের সবচেয়ে মজার স্ট্রিট ফুড হিসেবে উল্লেখ করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের এটি চেখে দেখার আহ্ববান করেন। এছাড়াও পিঠা, মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার, ঘোড়ার গাড়ি ও রিকশায় চড়ার আহ্বান জানান।
মেয়র বলেন, ‘জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমরা মেগা সিটি কিন্তু আকারে বড় না। একশ নয় বর্গ কিলোমিটারের এই শহরে কোটির বেশি মানুষ। ট্রাফিক জ্যামসহ নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা আপনাদের অনেক সুন্দর লাগবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ফরাসি আর্কিটেক্ট ক্লদিও সেইচি বলেন, ‘পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করার জন্য ঢাকা, মুম্বাই, ত্রিভেন্দ্রম ও প্যারিসের আর্কিটেকচার স্কুলের অর্ধশতাধিক স্থাপত্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এসেছেন। পুরান ঢাকার আটটি নদীর ঘাটে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পুরান ঢাকার বিপন্ন ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো অনুসন্ধানের জন্য কাজ করবেন। এই কর্মশালা এবং প্রদর্শনী জুড়ে; শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার অঙ্কন, মানচিত্র, স্কেচ, পর্যবেক্ষণ এবং আলোকচিত্র প্রদর্শন করবেন প্রতিদিন সকাল আটটার আগে পুরান ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা আট ঘণ্টা কাজ করে। নানা পেশার মানুষের ইন্টারভিউ, ভিডিও, ছবি তোলার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। নানা পেশার মানুষের সঙ্গে দেখা করে। ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলো দেখে এসে অভিজ্ঞতা থেকে ছবি আঁকে।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স থিজ উডস্ট্রা বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নদীগুলোকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, তাদের রক্ষা করতে হবে। নেদারল্যান্ডস অত্যন্ত দূষিত নদীকে রক্ষা করেছে। অন্যরাও পারবে।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত মাহি মাদুপুঁই বলেন, ‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব তথ্য-উপাত্ত উঠে আসবে তা তোমাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এ সময় তিনি প্যারিস থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা ঢাকা বা বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশি কিছু জানো না হয়ত। এই কাজের মাধ্যমে ঢাকার মত আধুনিক শহরের ভিত্তি কীভাবে তৈরি হয়েছিল তা তোমরা জানতে পারছ যা তোমাদের চেনা-জানার জগত থেকে অনেকটাই আলাদা। তোমাদের পুরান ঢাকার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার চেষ্টা কর যে এখানে সবকিছু কীভাবে চলে, কেন বদলাচ্ছে না, আরও কীভাবে ভালো করা যায়, কীভাবে ভালোর দিকে বদলানো যায়। আশা করি এই প্রোগ্রাম তোমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করবে।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘ঢাকার, বিশেষ করে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নতুন নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে ভালো লাগছে। আমি বিশ বছর ধরে পুরান ঢাকায় যাই কিন্তু এটি আমাকে কখনওই সারপ্রাইজ দিতে ব্যর্থ হয় না। বুড়িগঙ্গায় কাঠের নৌকা উঠলে নানারকম বৈচিত্যময় অভিজ্ঞতা হবে। তোমরা অবশ্যই স্থানীয় খাবার খাবে, রিকশায় চড়বে। একইসঙ্গে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনাও তোমাদের সাহয্য করবে অনেককিছু শিখতে।’
ভারত থেকে আসা আর্কিটেক্ট কমলিকা বোস এই প্রজেক্টে এক্সপার্ট রিসোর্স পারসন হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় একইরকম। আমরা দুই বছর ধরে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পার্টনারশিপ করে এই ওয়ার্কশপ পরিচালনা করছি। এবার বাংলাদেশ থেকে বুয়েট যুক্ত হয়েছে। আশা করছি বিভিন্ন দেশের ও কালচারের ছাত্র- ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে। এই প্রদর্শনীতে পুরান ঢাকার স্থানীয় মানুষ যারা নানা পেশায় জড়িয়ে আছে তাদের লাইফ তুলে ধরা হয়েছে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঢাকার ইতিহাসের নানা ধাপ। সেগুলো নিয়ে কাজ করাই উদ্দেশ্য।’
প্রকল্পটি ইউনিক ক্লাস্টার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে (আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, ব্রিটিশ কাউন্সিল, স্প্যানিশ দূতাবাস), যা বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্টনারশিপে এবং নেদারল্যান্ডসদূতাবাস দ্বারা সমর্থিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বৃহত্ত আর্ট ফাউন্ডেশন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, পাঠশালা দক্ষিণ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউ আছে লোকাল পার্টনার হিসেবে।
সারাবাংলা/আরএফ/একে