ক্যানসার আক্রান্তদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ করতে হয়
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:১৯
ঢাকা: আলোকচিত্রী রায়না মাহমুদ ২০১৯ সালে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘ক্যানসার রোগী ও তার পরিবারকে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক— তিন ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ক্যানসার চিকিৎসার আট মাস পর আমার শরীরে আবার একই রোগ ফিরে আসে। এখনও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।’
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে ক্যান্সার কেয়ার কমিউনিটি বাংলাদেশের আয়োজনে ক্যানসার লড়াকুদের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সভায় নিজের কথা এভাবেই তুলে ধরেন রায়না মাহমুদ।
৪ ফেব্রুয়ারি ক্যানসার দিবস উপলক্ষে এদিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসা পরিস্থিতি ও করণীয়। ‘একসাথে চলি ক্যানসার চিকিৎসায় বৈষম্য দূর করি’ স্লোগানকে সামনে রেখে এবার দিবসটি পালন করে ক্যানসার কেয়ার কমিউনিটি সোসাইটি।
এদিন অনুষ্ঠানে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলে একাধিক ক্যানসারযোদ্ধা অভিযোগ করেন। ক্যানসার রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যেতে হচ্ছে, তা নিয়েও সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন তোলেন তারা।
এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনুষ্ঠানে দক্ষ চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্যানসারের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন ক্যানসারজয়ী ও চিকিৎসকরা।
অনুষ্ঠানে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি নানা করণীয় বিষয়েও সুপারিশ করেন ক্যানসারজয়ীরা। দেশের ক্যানসার চিকিৎসার বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কথাও উঠে আসে আলোচনায়।
অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা যখন জানানো শুরু করেন রায়না মাহমুদ তখন হলজুড়ে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে যখন চোখের জল গড়িয়ে পড়ে তখন তা ছুঁয়ে যায় অন্যদেরও। কারণ এদিন মিলনায়তনে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের বেশির ভাগই ক্যানসারে পরিবারের কোনো সদস্যকে হারিয়েছেন, কিংবা নিজেও ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। অথবা কেউ ক্যানসার আক্রান্ত স্বজনের কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন দীর্ঘদিন। অনেকেই ছিলেন যারা এখনও স্বজনদের পাশে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
রায়না মাহমুদ বলেন, ‘নিজে ক্যানসার রোগী, এভাবে কখনো ভাবতে চাইতাম না। সবার সঙ্গে সুস্থভাবে চলাফেরা করি। সবকিছু নিজে নিজে করি। কিন্তু কেমোথেরাপির পর যখন চুলগুলো পড়ে গেল, তখন আর সহ্য করতে পারিনি। কঠিন বাস্তবতা বুঝতে পারি। তখন চিন্তা করা শুরু করি। এটা সহ্য করাটা খুব কঠিন। তবে বন্ধু–স্বজনেরা পাশে ছিলেন, আছেন এবং চিকিৎসক যখন বলেন, তুমি ভালো হয়ে যাবে, তখন লড়াই করার সাহস পাই।’
তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার, বন্ধুরা যদি পাশে না থাকতো তাহলে এই পথচলা সম্ভব হতো না। যারা বিত্তশালী তাদের হেল্প দরকার চিকিৎসার সহযোগিতার জন্য। অর্গানিক খাবার খুবই জরুরি।’
অভিনয়শিল্পী এবং মিস বাংলাদেশ ইউকে খেতাব পাওয়া সুলতানা সারা বলেন, শু‘ধুমাত্র বাংলাদেশে ক্যানসার ডায়াগনোসিসে ভুল হচ্ছে— বিষয়টি কিন্তু মোটেও তা নয়। ব্যাংককে আমি নিজে ভুল ডায়াগনোসিসের ভুক্তভোগী। বাংলাদেশেও ভুল চিকিৎসার শিকার হই। তবে সবকিছুর পরও সেজেগুজে সব সময় ভালো থাকার চেষ্টা করি। কেননা, ক্যানসার লড়াইয়ে মানসিক জোর থাকাটা জরুরি।’
অনুষ্ঠানে ক্যানসার জয়ী ও চিকিৎসক ড. জেসনিন ফারহানা সীমা বলেন, ‘এই রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। নিয়মিত আমাদের পরিচিত কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবারের একজন মানুষ আক্রান্ত হলে কী ধরনের সমস্যা হয় তা শুধু সেই পরিবারই জানে।’
তিনি বলেন, ‘আমি দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছি। সবার পরামর্শ ছিল কঠোর পরিশ্রম করা, এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। আমাদের নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে জরুরি। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিয়ে আমি কাজ করছি। সম্পূর্ণ কীটনাশক মুক্ত বাগান তৈরি করছি।’
ক্যানসারজয়ী ড. খালেদা খানম বলেন, ‘রোগীর জন্য সবচেয়ে জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা। এটার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা দরকার। আমাদের দেশে নির্দিষ্ট বিভাগে দক্ষ ডাক্তার খুব কম। সব রোগের চিকিৎসা ডাক্তারকে দিতে হয়। একটা বিষয়ে দক্ষ এবং ওই রোগের জন্য ডেডিকেটেড ডাক্তার থাকতে হয়। তাহলে রিপোর্টে ভুল হবে না। চিকিৎসায় ভুল হবে না। সঠিক চিকিৎসা পাবে সেবাগ্রহীতারা।’
এছাড়াও ডায়াগনোসিস বা বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ক্যানসার শনাক্ত হতেই সময় লাগছে বা ডায়াগনোসিস ভুল হচ্ছে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক ক্যানসার আক্রান্ত ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘আমরা যেন পেশেন্ট গ্রুপ গঠন করে আক্রান্তদের মেন্টরিং করি। একজন ক্যানসার সারভাইভার যে কতটা কষ্ট সহ্য করে আসে এটা শুধু সেই জানে। আমি তাদের স্যালুট জানাই। আলাদাভাবে এখান থেকে চিকিৎসা ওখান থেকে পরামর্শ নিলে চিকিৎসাটা পূর্ণ হবে না, সমন্বিত হবে না। এই সমন্বিত পরিকল্পনা খুবই দরকার। একটা জাতীয় প্রোগ্রাম দরকার যেখানে সবকিছু থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একসময় ক্যানসার নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইতেন না বা কথা শুনতে চাইতেন না। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। ক্যানসার চিকিৎসাতেও ৫০০ শয্যার জাতীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ৮টি বিভাগীয় শহরে আটটি ক্যানসার সেন্টার তৈরির কাজ চলছে।’
রোগী অনুপাতে এ চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো অপ্রতুল উল্লেখ করে ডা. রাসকিন বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সমন্বিত পদ্ধতির পাশাপাশি জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও নেই। ক্যানসার হলে সবাই মারা যাচ্ছেন না, যারা বেঁচে থাকছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কথাও ভাবতে হবে।’
সভায় অন্য বক্তারা বলেন, ‘আসুন ক্যানসার প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। আশা করি আগামী বছর ক্যানসার দিবসে আমরা আরও বৃহত্তর পরিসরে সম্মিলনি করতে পারবো।’
অনুষ্ঠানে দেশের মানুষকে এই রোগের বিষয়ে সচেতন করে তোলা এবং সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর জোর দেন বক্তারা। আলোচনা সভার পাশাপাশি চিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্যানসার কেয়ার কমিউনিটি বাংলাদেশ।
সারাবাংলা/এসবি/এমও