Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইউনুসকে একা রেখে চলে গেলেন সেই দুই ‘পাগল’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ষাটের দশকের শেষভাগের তিন ছাত্রলীগ নেতা। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ ইউনুস। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মধ্যেই এই তিনজন তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডারের বাসভবনে দুঃসাহসিক আক্রমণ চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। বন্দি অবস্থায় অমানুষিক নির্যাতন সয়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ‘পাগল’ সেজে হানাদার বাহিনীর বন্দিশালায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে চলে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে।

বিজ্ঞাপন

দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করা এই তিন বীরের মধ্যে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনাবসান হয়েছে পাঁচ বছর আগে। চলে গেলেন মোছলেম উদ্দিন আহমেদও। সহযোদ্ধা হারানোর ব্যাথায় কাঁদছেন মোহাম্মদ ইউনুস।

মোছলেম উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর সারাবাংলার পক্ষ থেকে মোহাম্মদ ইউনুসের কাছে একাত্তরের সেই যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণের অনুরোধ করা হয়েছিল। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই চলে গেছেন। মোছলেম ভাইও আমাকে ফেলে চলে গেলেন। আমি বড় একা হয়ে গেলা, বড় একা। সারারাত ‍ঘুমাতে পারিনি। তিনজন একসঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলাম। কী নির্যাতন যে করা হয়েছিল, ভাষায় বলতে পারবো না। আজ শুধু সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে।’

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা মৌলভী ছৈয়দ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল। সেই বাহিনীর সদস্য মোহাম্মদ ইউনুস জানালেন, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন জওয়ান সিটি কলেজের মাঠে প্রতিরাতে বাহিনীর সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এক রাতে জয় বাংলা বাহিনীর কাছে খবর এল- শহরের কাজির দেউড়ির অদূরে নেভাল এভিনিউতে নেভাল কমান্ডোরা এসে অবস্থান নিয়েছেন।

‘আমার কাছে একটা রাইফেল, মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে একটা রাইফেল, নায়েক সুবেদার সিদ্দিকুর রহমানের কাছে হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল আর মোছলেম ভাইয়ের কাছে দরকারি কিছু কাগজপত্র ছিল। খবর পেয়েই আমরা সেখানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা বুঝতে পারিনি তাদের কাছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র আছে। আমাদের কাছে ছিল সেভেন এমএম রাইফেল যেগুলো থ্রি নট থ্রি থেকে আরও দুর্বল। সেগুলো আমরা মাদারবাড়ির একটি গুদাম থেকে লুট করেছিলাম।’

বিজ্ঞাপন

দুঃসাহসিক সেই অভিযানের বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘সেই রাইফেল নিয়ে ভোরের দিকে আমরা নেভাল এভিনিউতে নেভাল কমান্ডার মমতাজের বাসায় আক্রমণ করি। একপর্যায়ে আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেল। পাকিস্তানি নৌ কমান্ডোদের কাছে হেভি মেশিনগান ছিল। ওরা তিনদিক থেকে ঘেরাও করে আমাদের ধরে ফেলল। কাজির দেউড়ির মোড়ে আমি, মহিউদ্দিন ভাই, মোছলেম ভাই আর নায়েক সুবেদার সিদ্দিকুর রহমানকে এক সারিতে দাঁড় করাল।’

সেই যাত্রায় কীভাবে প্রাণে বাঁচলেন তার বর্ণনা দিলেন, ‘আমাদের বলল- তোমরা কলেমা পড়। আমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ পড়ার আগেই জামালখানের দিক থেকে শত, শত মানুষ পাক আর্মিদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকল। তখন আমাদের গুলি করার জন্য স্টেনগান নিয়ে যে হাবিলদার দাঁড়িয়েছিল, সে আমাদের বাদ দিয়ে ওদের গুলি করা শুরু করল, আমরা বেঁচে গেলাম।’

ইউনুস জানালেন, জনতার আক্রমণের মুখে নেভাল কমান্ডার চারজনকে কাজির দেউড়ি থেকে তার বাসভবনে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। দিনভর সেখানে রেখে সন্ধ্যার পর তাদের টাইগারপাসে নৌবাহিনীর বখতেয়ার ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই সেলের এক সেলে মহিউদ্দিন ও ইউনুস এবং আরেক সেলে মোছলেম ও সিদ্দিকুরকে রাখল। সেখানে চারজনকে কয়েকঘণ্টা বেধড়ক পেটানোর একপর্যায়ে গভীর রাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সেল থেকে বের করে নিয়ে গেল। তিনজন শুনলেন বাইরে গুলির শব্দ।

‘নেভীর এক জওয়ান এসে আমাদের বলল— তোমারা ভাই মহিউদ্দিনকে খতম করলিয়া। এটি শুনে মোছলম ভাই কেঁদে উঠলেন। বললেন- মহিউদ্দিন ভাইকে তো মেরে ফেলেছে, গুলির আওয়াজ শুনেছ ইউনুস ? আমি বললাম- কিছু তো করার নেই মোছলেম ভাই, মহিউদ্দিন ভাইয়ের জন্য দোয়া করেন আল্লাহ যেন উনাকে বেহেশতে নসিব করেন। এরপর একদিন আমাদের সেখানে রাখল।’

‘পরদিন আমি আর মোছলেম ভাইকে চোখ বেঁধে নিয়ে গেল, স্টিমারের আওয়াজ শুনলাম। মোছলেম ভাইকে বললাম- এটা স্টিমারের আওয়াজ, মহিউদ্দিন ভাইকে মনে হয় মেরে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে, আমাদেরও মনে হয়…। মোছলেম ভাই কাঁদছেন, বললেন— আমার মা তো মনে হয় পাগল হয়ে যাবেন।’

বীর যোদ্ধা ইউনূস জানালেন, তাদের নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে নেভীর অফিসাররা দু’জনের ঘাড়ে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দিতে লাগল। হঠাৎ তারা মহিউদ্দিন চৌধুরীর আওয়াজ শুনলেন। তাঁকে কোমড়ের বেল্ট খুলে পেটাচ্ছিল।

‘সিগারেটের আগুনের ছ্যাকার যন্ত্রণা ভুলে গেলাম। মহিউদ্দিন ভাই বেঁচে আছেন এটা অনেক বড়কিছু। আবার তিনজন একসাথে হলাম। আমাদের সেখানে কয়েকদিন রেখে জেটিতে লেবারের কাজ করাতে লাগল। আমার বয়স তখন মাত্র ১৫-১৬। একদিন জেটিতে মহিউদ্দিন ভাইকে বললাম- আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে চলে যাব, কপালে যা আছে তা-ই হবে। মহিউদ্দিন ভাই আর মোছলেম ভাই আমাকে ধরে রাখলেন। তখন দেখলাম বন্দি এক কিশোর ঝাঁপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, দেখলাম, দেখলাম কর্ণফুলীর পানি লাল।’

ইউনুসের বর্ণনা অনুযায়ী, কয়েকদিন পর তাদের চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে যাওয়া হল। কারাগারের চার্জে ছিল এক বেলুচ ক্যাপ্টেন। জেলার ছিলেন চট্টগ্রামের একজন, নাম খালেক। তিনি ইউনুসকে চিনতেন, কারণ তিনি নয় মাস জেল খেটে বের হয়েছিলেন। জেলার গোপনে তাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকলেন।

‘দুই মাস ধরে বন্দি। ধরেই নিয়েছিলাম মৃত্যু অবধারিত। হঠাৎ একদিন বেলুচ ক্যাপ্টেন বললেন— এখানে কিছু পাগল আছে, তাদের ছেড়ে দেয়া দরকার। জেলার বললেন- স্যার এদের জ্বালায় অতীষ্ঠ, হয় ছেড়ে দেন, না হয় মেরে ফেলেন। ক্যাপ্টেন বললেন— না, না ওদের ছেড়ে দিতে পারি কি না দেখি। খালেক সাহেব সেটা আমাদের গোপনে বলে দিলেন। তখন আমরা চিন্তা করলাম পাগল সেজে পৌরসভার ময়লার গাড়ির মধ্যে শুয়ে বের হয়ে যাব। কিন্তু এর মধ্যেই পাগল ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা আসল।’

পাগল সেজে জেলমুক্তির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন পাগল ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা শুনলাম, তখন আমরা তিনজন কাপড়চোপড় খুলে ফেলেছি। গায়ে ময়লা মেখে নিয়েছি। বেলুচ ক্যাপ্টেন এসে আমাদের কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে বললেন, এই পাগলগুলোকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও। আমরা তিনজন ছাড়া পেয়ে জেল রোডে আমানত শাহ মাজারে ঢুকে পড়ি। তখন নেভাল কমান্ডো, যারা আমাদের গ্রেফতার করেছিল তারা খবর পেয়ে মাজারে আসে। কিন্তু তার আগেই আমরা সেখান থেকে সরে পড়ি।’

বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে কয়েকদিন পর তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বলে জানান মোহাম্মদ ইউনুস, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদের’ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিন বীরের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মারা যান। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে মারা গেছেন।

সারাবাংলা/আরডি/একে

চট্টগ্রাম মোসলেম উদ্দীন স্মৃতিচারণ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর