নিপাহ ভাইরাসে মারা গেছে নবজাতকও!
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৩৫
ঢাকা: পেশায় গাড়িচালক জসীম মিয়ার (ছদ্মনাম) গর্ভবতী স্ত্রী মনিরার (ছদ্মনাম) সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয় ১৫ জানুয়ারি। উপজেলার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে জসীম-মনিরা দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় পুত্র সন্তান। হাসপাতাল থেকে সুস্থ নবজাতক ও স্ত্রীকে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরে যান জসীম। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের দাওয়াত করে খাওয়ায় জসীম। এরই মাঝে বাড়ির সবাই মিলে খায় খেজুরের কাঁচা রস।
এক সপ্তাহ পরেই পাল্টে যায় জসীমের ঘরের পরিস্থিতি। মনিরার তীব্র জ্বর আসে ও মাথাব্যথা শুরু হয়। একটা পর্যায়ে জ্বর কম অনুভূত হলে চিকিৎসকের কাছে আর যাওয়া হয়নি তাদের। তবে বেশি তার পরদিনই তীব্র জ্বরের পাশাপাশি শরীরে খিঁচুনির লক্ষণ দেখা দেয় মনিরার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে তার চিকিৎসা শুরু করা হয়। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম পাওয়া যাওয়ার কারণে রক্ত দেওয়া হয় মনিরাকে। এ দিন তার মুখ থেকে লালা পড়তেও দেখা যায়। তবে পরদিন কিছুটা সুস্থ অনুভব করলে জসীমকে বলে বাড়ি থেকে একমাত্র মেয়ের পাশাপাশি নবজাতককেও যেনো নিয়ে আসে হেলথ কমপ্লেক্সে।
জসীম সারাবাংলাকে বলেন, আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার ১৩-১৪ দিন বয়সী সন্তানের গলা ফোলা। সেদিনই আমার ভাই তাকে নিয়ে যায় জেলা শহরের হাসপাতালে। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাও দেওয়া হয়। কিন্তু ৩১ জানুয়ারি মারা যায় আমার ছেলেটা। এরপরে তার মাকেও উপজেলা থেকে জেলা শহরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। মনিরাকেও আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এখন সে কিছুটা সুস্থ হলেও স্মরণ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ এক-দুই মাস আগের কথাও তার মনে নেই।’
তবে সে এখনো জানে না যে আমাদের সন্তান আর পৃথিবীতে নেই। আমরা তাকে জানানোর সাহস করতে পারছি না। আর তারও অসুস্থতার কারণে কিছু মনে নেই। কেন যে ভুল করে খেজুরের রস খেয়েছিলাম সবাই? এ কী শাস্তি দিল সৃষ্টিকর্তা আমাদের?- কাঁদতে কাঁদতে প্রতিবেদকের কাছে কথা গুলো বলছিল জসীম।
নবজাতক মারা যাওয়ার পরে স্ত্রীকে নিয়ে এখনও হাসপাতালেই সময় কাটাচ্ছেন জসীম। এক অজানা আশঙ্কায় দিন কাটানো জসীম স্ত্রীর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
জসীম বলেন, চিকিৎসকরা কিছু বলতে পারছেন না এখনো। ওর কিছুই মনে থাকে না তেমন। বাড়ি বা বাচ্চার কথাও জিজ্ঞেস করে না। মনের দিক থেকে তাকে মনে হয় স্বাভাবিক আছে কিন্তু তার নাকি প্রচুর খিদে লাগে। আবার শরীরও নাকি দুর্বল লাগে। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।’
একটা ভুল আমার পুরো সংসার শেষ করে দিলো। খেজুরের রস খেয়ে পুরা পরিবারটাই শেষ আমার। তাদের দুইজনের পরে আমাদেরও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নাকি ওই রোগ হয়নি… বলতে বলতেই আবার কান্না করতে থাকে জসীম।
মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) মনিরার চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরইমধ্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিশ্চিত করেছে মা ও সন্তানের নমুনা নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার পরিস্থিতি আমরা এখনও পর্যবেক্ষণ করছি। আগের চাইতে ইম্প্রুভ হওয়ার কারণে তাকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে পর্যবেক্ষণের জন্য।’
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলতি বছর দেশের ছয়টি জেলায় এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১০ জন। এর মাঝে মারা গেছেন সাতজন। এই সাতজনের মাঝে এই নবজাতকও আছে। তার মা নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হলেও তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে কত জন নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে তার অনুসন্ধান চলছে। মৌসুম শেষে প্রকৃত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা জানা যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, এরইমধ্যে খেজুঁরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য প্রচারণা চালানো হয়েছে মৌসুমের শুরু থেকেই। কিন্তু তাও আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনসচেতনতা আরও বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে অধিদফতর।
মা থেকে নবজাতকের দেহে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি প্রবাহ সম্ভব
প্রথমবারের মতো মা থেকে সন্তানের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি বা সম্ভাব্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রবাহের প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী এবং সহযোগীদের একটি নতুন গবেষণার ফলাফল ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তি থেকে অন্যজনে সম্ভাব্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রবাহের নতুন তথ্য প্রদান করা হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন আইসিডিডিআর,বির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) বিজ্ঞানী এবং সহযোগীরা।
গবেষণা প্রসঙ্গে প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআর,বির ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনের অন্তর্গত ইমার্জিং ইনফেকশন্স শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ড. সৈয়দ মইনুদ্দীন সাত্তার বলেন, ‘আমাদের জানা মতে এই গবেষণাই প্রথম নিপাহ ভাইরাসভিত্তিক ইমিউন প্রপার্টিজের ভার্টিকেল ট্রান্সফার বা মা থেকে শিশুতে পরিবাহিত হওয়ার প্রমাণ নিশ্চিত করে।’
আইইডিসিআর’র প্রতিবেদন অনুযায়ী নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান
চলতি বছর দেশে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী বিভাগের গোদাগাড়ি উপজেলায় এক নারী। ৩৫ বছর বয়সী এই নারী নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা এলাকার এই বাসিন্দা নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমিত হয়ে ১ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ৩ জানুয়ারি তার সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায় নমুনা পরীক্ষা। পরবর্তীতে ৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলা সদরের ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরের নমুনা পরীক্ষা করে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। ১১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত এই কিশোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
রাজশাহী বিভাগেরই নওগাঁ জেলা সদরের আরেক নারী গত ৬ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হলেও একইদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
নওগাঁ জেলা সদরের এই দুইটা ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আক্রান্তদের সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া শুরু হয় ২৩ ডিসেম্বর থেকে।
ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলার বালাকান্দি উপজেলায় ছয় বছর বয়সী এক কন্যা শিশু হাসপাতালে ১৪ জানুয়ারি নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে গত ২১ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১৮ বছর বয়সীকে হাসপাতালে আনা হয় অজ্ঞান অবস্থায়। চিকিৎসকরা জানান, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কয়েকবার খিঁচুনির কথা। এছাড়াও সঙ্গে ছিল জ্বর আর প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট ও এক দিন আগ থেকে শুরু হওয়া পাতলা পায়খানা।
স্বজনরা জানায়, রোগী বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ১ জানুয়ারি কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার পার্টি করে। এরপরে ধীরে ধীরে তার মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৮ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরদিনই সে মারা যায়।
২০ জানুয়ারি সকালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাত বছরের শিশু ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সোয়াদ হোসেন খেজুরের কাঁচা রস পান করেছিল। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে বাড়তে থাকে জ্বর। একইসঙ্গে শুরু হতে থাকে খিচুঁনি। প্রথমে কবিরাজ ও পরে ঈশ্বরদী হাসপাতালে নিলে অবস্থার অবনতি হওয়ায় পাবনা থেকে নেয়া হয় রাজশাহী মেডিকেলে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ২১ জানুয়ারিই সোয়াদকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। নমুনা পরীক্ষায় তার শরীরে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ২৩ জানুয়ারি শিশুটি মারা যায়।
সোয়াদের বাবা সানোয়ার হোসেন জানান, প্রায় ২০ দিন আগে সোয়াদসহ পরিবারের সবাই মিলে খেজুরের রস খায়। গত ১৫ জানুয়ারি বিকেলে স্থানীয় স্কুলমাঠে খেলা অবস্থায় সোয়াদ অসুস্থবোধ করে। ওই দিন রাতে সোয়াদের জ্বর আসে এবং নাপা ট্যাবলেট খাওয়ানোর পর জ্বর কমে যায়। এর তিন দিন পর সেলিমপুর বাজারের শাহজাহান চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে অবস্থা খারাপ হলে ২০ জানুয়ারি ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই দিনই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ভর্তি করার পর চিকিৎসক দেখে কিছু টেস্ট দিলে সেগুলো হাসপাতাল থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। রোববার রিপোর্টে নিপাহ ভাইরাস ধরা পড়ে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে সোয়াদ মারা যায়।
ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় ২৯ বছর বয়সী এক তরুণের মাঝে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ১৭ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তিনি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের এক বাসিন্দার মাঝে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন।
নাটোরের বাগাতিপাড়ায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিয়াম (১৩) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। সিয়াম বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের করমদোশী গ্রামের কৃষক কামরুল ইসলামের ছেলে। সিয়াম দোবীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
সিয়ামের পরিবার জানায়, কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে সিয়াম নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। গত ১৭ জানুয়ারি নানা সাজেদুরের বাড়িতে গিয়ে খেজুরের রস খায়। এরপর থেকে সে সামান্য মাথাব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হলেও সে সুস্থ হয়নি। পরে গত ২৯ জানুয়ারি জ্বরের পাশাপাশি কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
এরপরেই পরিবারের সদস্যরা রাতে পার্শ্ববর্তী পুঠিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাতেই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ জানুয়ারি সিয়াম মারা যায়।
চলতি বছরে কোন কোন জেলায় আক্রান্ত?
আইইডিসিআর জানিয়েছে, এ বছর এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ জনকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছে। এসব রোগী শনাক্ত হয়েছে শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর—এই ছয় জেলায়। আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে ৬ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন চারজন পুরুষ ও তিনজন নারী। অর্থাৎ মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, চলতি বছরে এ পর্যন্ত দেশে কত জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেটি এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলার সময় হয়নি। এখন অনুসন্ধান চলছে। শেষ হলে রোগী ও মৃতের সংখ্যা জানা যাবে।
তিনি বলেন, ‘খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। খেজুরের কাঁচা রস নিয়ে কোনো উৎসব করা বা উৎসবে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া ঠিক হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারাদেশেই নিপাহ ভাইরাসের সার্ভিলেন্সের কাজে জোর দিচ্ছি। যেখানেই নতুন কেস পাওয়া যাচ্ছে আমরা সেটা আপডেট করে নিচ্ছি। একইসঙ্গে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছি। কয়েক দিন ধরে নিয়মিতভাবে সন্দেহজনক রোগীর তথ্য আমাদের কাছে আসছে।’
ডা. তাহমিনা বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিতদের জন্য এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা ওষুধ নেই। আক্রান্ত হওয়ার পরে যদি কেউ বেঁচেও যান তবে তার শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শুধু একটাই উপায় আর তা হলো খেজুরের কাঁচা রস খাওয়াটা বন্ধ করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে আমরা ঝুঁকিমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলে সতর্কতা অবলম্বন করে খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এটা কিন্তু ভুল কথা। কারণ, বাদুরের মুখ দিয়েই শুধু না বরং ইউরিন থেকেও কিন্তু এটা ছড়াতে থাকে। অনেকে জাল দিয়ে ঢেকে রাখে যেন বাদুর মুখ না দিতে পারে। কিন্তু ইউরিন তো আর তাতে আটকায় না। তাই আক্রান্তের সম্ভাবনা সবসময়েই থাকে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের হার কম হলেও ভাইরাসটি খুবই বিপদজনক। এই রোগে মৃতের হার খুবই বেশি। তাই প্রতিকারের চেয়ে আমাদের প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মূলত নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় হলো কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এই প্রচারটাই আরও জোরদার হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ধর্মীয় নেতারা জুমার খুতবায় যদি সাধারণ মানুষকে কাঁচা রসের বিষয়ে সতর্ক করে, এটির সামাজিক গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। আমরা আমাদের সীমিত বাজেট অনুযায়ী প্রচারণা করছি। আমরা যশোর-খুলনা অঞ্চলে অ্যাডভোকেসি কমিউনিকেশন ও সোশাল মোভিলাইজেশনের জন্য সরকার থেকে আমরা আমাদের লোকজন পাঠাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের তো জনবল কম, এরমধ্যেই আমাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মিটিং-অ্যাডভোকেসি করছে। কিন্তু এর পাশাপাশি যদি গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারটা হতো, টেলিভিশনে, টকশোতে আলোচনা হতো, তাহলে ভালো হতো। কারণ, আমাদের যে বিজ্ঞাপনের কলেবর, আমরা তো প্রতিদিন বিজ্ঞাপন আর প্রতিটি মিডিয়াকে কাভার করতে পারি না। এক্ষেত্রে সংবাদকর্মীরা চাইলে বিভিন্ন সংবাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে পারেন।’
এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও নিপাহ ভাইরাসের টিকার কোনও খবর নেই। আর তাই খেজুরের কাঁচা রস, বাদুড়ে খাওয়া কলাসহ বিভিন্ন ফলমূল থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান ডা. নাজমুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে আইসিইউ প্রস্তুত রেখেছি কারণ এটি সাংঘাতিক রকমের সংক্রমণ। এই রোগীকে কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল নেবে না। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা রোগীরা ঝুঁকিতে থাকতে পারে তাদের জন্য। তাই এদের আলাদা করে রেখেছি। ভয় না পেয়ে সবাইকে নিপাহ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, ‘প্রথম কেইস থেকে এখন পর্যন্ত থেকে যে জায়গাগুলোতে নিপাহ ভাইরাস পাওয়া গেছে, সবগুলো জেলাই আমাদের দৃষ্টিতে সন্দেহভাজন। কোনো একটি জেলায় একবার হয়েছে, সেটিও সংক্রমিত জেলা। এক জেলায় একবার হয়েছে মানে যে ওই জেলায় আর হবে না, এমন তো নয়।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, ‘কোনো জায়গায় একবার নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে ওই স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কারণ যেখানে নিপাহ ভাইরাসের রোগী পাওয়া যায় সেখানে বাদুরও থেকে যায়, খেজুরের রসও থাকে। দেশের সব এলাকাই নিপাহ ভাইরাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু যেসব জেলায় ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে, সেসব জেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে কমবেশি সবার খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ইতিহাস আছে। কাঁচা রস পান করা যাবে না, এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছাতে হবে।’
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ। ২৯ শতাংশ মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা রয়েছে। এই ভাইরাস প্রথমে রোগীর মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটায়। এতে এক পর্যায়ে পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। গত ২২ বছরে দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩২৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৩১ জনের। চলতি বছরে এ পর্যন্ত আটজন আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। আগের বছর ২০২২ সালে আক্রান্ত হয় তিনজন। মারা যায় দুজন। এর আগে ২০২১ সালে আক্রান্ত দুজন বেঁচে আছে। তবে আগের বছর ২০২০ সালে আক্রান্ত সাতজনের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। বিশেষ করে মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, মাদারীপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।
সারাবাংলা/এসবি/একে